আমরা নরকের মধ্যে আছি: গাজায় ফিলিস্তিনের দ্বৈত নাগরিকেরা
ইউসুফ আবু শাবান কয়েক দিন থেকেই রাফাহ ক্রসিংয়ে অপেক্ষা করছেন। ক্রসিংয়ের ওপারে মিসর। পরিবারের আরও চার সদস্য শাবানের সঙ্গে আছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য, এ ক্রসিং দিয়ে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ছেড়ে যাবেন।
১৯ বছর বয়সী আবু শাবান যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। মার্কিন কনস্যুলেটের কর্মকর্তারা তাঁকে বলেছেন, তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গাজা ছেড়ে যেতে পারেন। এরপর শাবান পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাফাহ ক্রসিংয়ের কাছে একটি বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলেন।
৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের লাগাতার বোমা হামলার কারণে শাবানের মতো অনেকেই গাজা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নানা উপায় খুঁজছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আছে, গাজায় এমন মানুষের সংখ্যা ৫০০ থেকে ৬০০। এই দ্বৈত নাগরিকদের গাজা ছেড়ে মিসরে যাওয়ার জন্য রাফাহ ক্রসিংয়ের কাছাকাছি যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
এর আগে ১৪ অক্টোবর বলা হয়েছিল, ওই দিন রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজা ছাড়ার জন্য পাঁচ ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। তবে দিন শেষে কেউই সেদিন গাজার বাইরে পা রাখতে পারেননি। ক্রসিংয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরও তাঁরা সেখানে অবস্থান করছেন। কখন এই ক্রসিং পার হতে পারবেন, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না।
গত শনিবার মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সরঞ্জাম নিয়ে কিছু গাড়ি মিসর থেকে ওই ক্রসিং দিয়ে গাজায় প্রবেশ করবে। তাঁরা জানতে পেরেছেন, এ কারণে দ্বৈত নাগরিকদের চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে ক্রসিং খোলা হতে পারে।
তবে এর আগেই শাবান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের গাজা ছাড়তে অনেক দেরি হয়ে যায়। এ দেরির কারণে অপূরণীয় ক্ষতিও হয়েছে পরিবারটির। শাবানের ১৪ বছর বয়সী বোনের প্রাণ গেছে হামলায়।
গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিন দিন ক্রসিংয়ের কাছে একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিল শাবানের পরিবার। এরপর দেরি দেখে আরও কিছু জিনিসপত্র নিতে পরিবারটি আবারও গাজা শহরে নিজেদের বাড়িতে ফিরে যায়।
শাবান বলেন, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ কারণে ওই দিন আমরা ঘরে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে রাফাহ ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এ সময় আমরা নিচতলার একটা কক্ষে চলে যাই। দেখি আমাদের ঘরের দরজায় গুলি করা হচ্ছে। এতে আমার বোন নিহত হয়।’ ‘কে তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবে?’ বলে আর্তনাদ করেন শাবান। তিনি নিজেও মুখে আঘাত পেয়েছেন।
শাবান আরও বলেন, তাঁর বাবা (৪৪) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। রাত ১১টার দিকে গোলাগুলিতে তিনিও হাতে আঘাত লেগে গুরুতর আহত হন। এ ছাড়া তাঁর আট বছর বয়সী আরেক বোন জিহান আহত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পরিবারে আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমাকে ছাড়া পরিবার অচল। বাবা অন্ধ, আর এখন তাঁর পুরো হাত অকেজো হয়ে গেছে।’
শাবানের মা-বাবা গাজা ছেড়ে অনেক বছর আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানেই তাঁর বাবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম হয় শাবানের।
শাবান বলেন, ‘দূতাবাসের অবহেলার কারণেই আমাদের আজ এই দশা। কেন আমার সঙ্গে, আমার বাড়িতে এমনটা ঘটল; কেন আমার বোন নিহত হলো—এ নিয়ে আমি আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক দিন থেকে মার্কিন কনস্যুলেটের প্রতিনিধিরা ফোন করে ক্রসিংয়ে যেতে বলছেন। আমি যাব, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাব।’
এদিকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষও গাজায় তাদের নাগরিকদের দক্ষিণ দিকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। ক্রসিং খুলে গেলে তাঁদের সতর্ক থাকতে বার্তা পাঠিয়েছিল। বিবিসির তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল ও গাজায় ৬০ হাজারের মতো ব্রিটিশ নাগরিক রয়েছে।
রাফাহ থেকে আল–জাজিরার সঙ্গে কথা বলার সময় আরেক দ্বৈত মার্কিন নাগরিক গত সপ্তাহে বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি হতাশাজনক’।
ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। আমার দেশ আমাকে এখানে আসতে বলেছে। আমরা এখানে এসে নরকের মধ্যে পড়েছি। মধ্য গাজা থেকে গাজার সীমান্ত পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে আছে। আমরা এখন খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। কী ঘটছে, তা আমরা জানি না। কেন আমাদের আসতে বলা হয়েছিল এবং কখন আমরা এখান থেকে বের হতে পারব, তা–ও জানি না।’
ওই দ্বৈত নাগরিক বলেছেন, তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে বার্তা দিয়েছেন। ওই বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি ইসরায়েলি হতাম তাহলে কি আমাদের সঙ্গে এমন ঘটত?’ কারণ, মার্কিন-ইসরায়েলিদের অনেকেই এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তাঁরা প্রতিদিন চলে যাচ্ছেন।
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘ফিলিস্তিনি-মার্কিনরা চলে যেতে পারছেন না। অন্য দেশের বংশোদ্ভূত মার্কিন-ফিলিস্তিনিরাও পারছেন না। এমন মানুষের সংখ্যা এখানে অনেক। তাঁদের প্রায় সবাই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। তাঁরা ক্রসিংয়ে যাওয়ার জন্য বিপজ্জনক এলাকা পেরিয়ে যেতে পারবেন না। কারণ, ওই সব এলাকায় একটি গোলাই আমাদের মেরে ফেলতে পারে।’
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এতে গাজা যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৬০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। হামাসের হামলায় ইসরায়েলে প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণ গেছে।
আল–জাজিরার প্রতিনিধি হিশাম জাকুত গত সপ্তাহে রাফাহ ক্রসিং প্রবেশ করেছিলেন। তিনি বলেছেন, গাজায় ত্রাণ প্রবেশের প্রস্তুতি চলছে। তবে এখনো বেশ কিছু বাধা আছে।
হিশাম জাকুত বলেছেন, গাজা উপত্যকায় ত্রাণ সরবরাহে বাধা দিতে ইসরায়েলি অভিযানে প্রধান সড়কে বড় বড় গর্ত করা হয়েছে। এরপরও তা ঠিকঠাক করে মিসর ত্রাণ সরবরাহে সহযোগিতা করছে। রাফাহ ক্রসিংয়ে ইসরায়েল অন্তত চারবার বোমা হামলা চালিয়েছে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা-ইউএনআরডব্লিউএর কথা উল্লেখ করে হিশাম বলেন, ‘আমরা আশা করছি, ক্রসিংটি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত কি না, তা দেখতে ইউএনআরডব্লিউএ দল আসবে। গাজার ভেতরেও ত্রাণ সাহায্য বিতরণ করা আরেকটি সমস্যা। জাতিসংঘ এ বিষয়ে মিসর কর্তৃপক্ষ, ইউএনআরডব্লিউএ কর্মকর্তা ও ইসরায়েলি পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে।’
গাজা উপত্যকার ভেতরে প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনি গত দুই সপ্তাহে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেকেই সেখানে ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। ৯ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় সরবরাহ বন্ধ করতে ‘সম্পূর্ণ অবরোধ’ ঘোষণা করে। এ কারণে গাজায় এখন পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।