ইসরায়েলের শর্তে যুদ্ধবিরতি নিয়ে শঙ্কা

গাজায় সাহায্য-সহায়তা পৌঁছাতে রাফা সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ। সোমবার ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় মিসরের দূতাবাসের সামনেছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘বেপরোয়া আচরণের ফলে’ ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনায় ফিরতে হঠাৎ নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তিনি। মিসরের কায়রোয় গত রোববার শুরু হওয়া আলোচনায় অংশ নেয়নি ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল। এদিকে গাজায় ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলে হামলায় আরও ১২৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে আরও শক্ত অবস্থান নিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। আলোচনায় ফেরার শর্ত হিসেবে জিম্মিদের তালিকা দেওয়ার নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তিনি। তবে এ দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের সম্মানিত ফেলো রামি খোরি বলেন, হামাসের কাছ থেকে জিম্মিদের তালিকা চাওয়ার নেতানিয়াহুর সর্বশেষ দাবি তাঁর বেপরোয়া আচরণের প্রতিফলন। তিনি বলেন, গাজায় টেকসই যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া এখনো কঠিনই রয়ে গেছে।

রামি বলেন, ‘প্রথম যুদ্ধবিরতির সময় হামাস জিম্মিদের নামের তালিকা দেয়নি। তালিকা দেওয়ার দাবিটি নতুন। এটা ইসরায়েলি সরকার নয়, নেতানিয়াহুর নিজের দাবি। তিনি শেষ মুহূর্তে এ দাবি করেছেন।’

জিম্মিদের তালিকা নিয়ে কেন জটিলতা

কায়রোয় গত রোববার শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতির আলোচনায় প্রতিনিধিদল পাঠায়নি ইসরায়েল। হামাসের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, দখলদার (ইসরায়েল) প্রতিনিধিদল ছাড়াই সোমবার দ্বিতীয় দিনের মতো কায়রোয় আলোচনা চলছে।

একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মধ্যে জীবিতদের তালিকা দিতে ইসরায়েলের দাবি না মেনে নেওয়ায় আলোচনায় প্রতিনিধিদল পাঠাতে রাজি হয়নি নেতানিয়াহু সরকার।

তবে মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। মিসরের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আল-কাহেরা নিউজ জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাস ও মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে।

কয়েক সপ্তাহের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর পবিত্র রমজান মাসের আগেই গাজায় ছয় সপ্তাহের সাময়িক যুদ্ধবিরতির সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র।

কাতারভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান বারারি বলেন, গোয়েন্দা নজরদারি-সংশ্লিষ্ট বিষয় হওয়ায় জিম্মিদের নামের তালিকা দিতে রাজি হচ্ছে না হামাস। তিনি বলেন, ‘যদি শিগগিরই চুক্তির বিষয়ে সমঝোতার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে পরে হামাস সম্ভবত জিম্মিদের নিয়ে তথ্য দেবে।’

হাসান বলেন, ‘এই মুহূর্তে জিম্মিদের বিস্তারিত তথ্য ইসরায়েলিদের সরবরাহ করা হামাসের জন্য কঠিন। যদি কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব না হয়, তাহলে এই তালিকার খুঁটিনাটি ইসরায়েল বিশ্লেষণ করবে, যা তাদের গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য প্রয়োজন।’

সমঝোতার আহ্বান কমলা হ্যারিসের

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় প্রস্তাবিত ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি চুক্তি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। একই সঙ্গে গাজায় অপর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা নিয়ে তিনি ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন।

গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে দেওয়া বক্তব্যে কমলা হ্যারিস বলেন, গাজায় চরম দুর্ভোগের পরিপ্রেক্ষিতে উপত্যকায় অন্তত ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি অবিলম্বে দরকার, যা এখন আলোচনার টেবিলে আছে।

গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়াতে নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে কমলা হ্যারিস বলেন, ‘ত্রাণসহায়তার প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে ইসরায়েল সরকারকে অবশ্যই আরও কিছু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত চলবে না।’

তবে কমলা হ্যারিসের কড়া সমালোচনা করেছেন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির। সোমবার সামাজিক যোগাযোগামাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, ‘এখন হামাস ও কমলাকে ধ্বংসের সময়।’

খাদ্য ও পানির অভাবে মারা পড়ছে শিশুরা

পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ না থাকায় খাদ্য ও পানির অভাবে অপুষ্টিতে ভুগে গাজায় শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে। এবার রাফার আল-নাজ্জার হাসপাতালে অপুষ্টিতে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এ নিয়ে গত কয়েক দিনে গাজায় অপুষ্টিতে মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ১৮-তে গিয়ে ঠেকেছে।

এর আগে উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে ১৫টি শিশু অপুষ্টিতে মারা যায় বলে গত রোববার জানিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া আল-শিফা হাসপাতালে একই কারণে দুই শিশুর মৃত্যুর কথা গত বুধবার জানানো হয়েছিল।

এদিকে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলের হামলায় আরও ১২৪ জন নিহত হয়েছেন বলে সোমবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এ নিয়ে গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ৩০ হাজার ৫৩৪ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ফিলিস্তিনিদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।

তবে ইসরায়েলের হামলায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, হাসপাতালে আসা মরদেহ হিসাব করে নিহতের পরিসংখ্যান দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গাজার বড় একটি অংশের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যোগাযোগ নেই।

এ ছাড়া ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় ৭২ হাজার ফিলিস্তিনি। নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ৮ হাজার। ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর ও স্থাপনার ধ্বংসস্তূপের নিচে তাঁদের মরদেহ পড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে।