মাসা আমিনি, ‘ইরানের জনগণের ক্ষোভের কণ্ঠস্বর’-এর এক নাম। পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু ঘিরে ইরানজুড়ে বেশ কয়েক দিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। পুলিশ বলছে, মাসা তাদের হেফাজতে থাকলেও ‘হৃদ্যন্ত্র বিকল’ হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর চাচাতো ভাই বলছেন, মৃত্যুর আগে মাসাকে নির্যাতন ও অপমান করা হয়েছিল।
স্কাই নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরফান মোরতেজাই পুলিশি হেফাজতে তাঁর বোনের সঙ্গে কী হয়েছে, তার বিস্তারিত জানিয়েছেন। ইরফান মাসার মৃত্যুর জন্য ইরান সরকারকে দায়ী করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতে মাসার মৃত্যুর পর এই প্রথম তাঁর পরিবারের কেউ পশ্চিমা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন।
মাসার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল নীতি পুলিশ। অভিযোগ, তাঁর হিজাব ছিল ঢিলেঢালা।
মোরতেজাই একজন রাজনৈতিক কর্মী ও পেশমারগা যোদ্ধা। তিনি ইরানের সীমান্তের কাছে ইরাকে বাস করেন। ইরাকের উত্তরে কুর্দি অঞ্চলের সুলায়মানিয়া থেকে স্কাই নিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, মাসা তাঁর ভাই আশকানসহ আত্মীয়দের সঙ্গে কুর্দিস্তান থেকে তেহরানে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন। পথে টহলরত নীতি পুলিশের মুখোমুখি হন তাঁরা। পুলিশের মনে হয়েছে, মাসাসহ কয়েকজন ঠিকভাবে হিজাব পরেননি। আশকান পুলিশকে বারবার বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁরা তেহরানের বাসিন্দা নন। এখানকার নিয়মকানুনের সঙ্গে তাঁরা অতটা পরিচিত নন। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের আটক না করার অনুরোধ জানান।
এই কথাবার্তার মধ্যেই পুলিশের কর্মকর্তারা আশকানের মুখের ওপর মরিচের গুঁড়া স্প্রে করেন এবং মাসাকে জোর করে তুলে নীতি পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যান।
মোরতেজাই বলেন, ওই ভ্যানে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী তাঁদের জানিয়েছেন মাসার সঙ্গে পরে কী হয়েছে। পুলিশ স্টেশনে নেওয়ার পথে মাসাকে নির্যাতন ও অপমান করা হয়। থানায় পৌঁছানোর পর মাসা দৃষ্টি হারান ও অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এর ৩০ মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্স আসে। আর হাসপাতালে নিতে লাগে দেড় ঘণ্টা।
মোরতেজাই বলেন, ‘কাসরা হাসপাতালের (তেহরানের) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে মাসা যখন হাসপাতালে পৌঁছান, ততক্ষণে সে মৃত।’ তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন।
ঘটনার পর থেকে মাসার পরিবারকে ইরানের টেলিভিশনের পর্দায় আসতে কর্তৃপক্ষ চাপ দিয়ে আসছে বলে দাবি করেন মোরতেজাই। পাশাপাশি তাঁর মা-বাবা ও ভাইকে চুপ করানোর চেষ্টাও করা হয়েছে, বলেন তিনি।
মোরতেজাই বলেন, রাজনীতির সঙ্গে মাসার কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও সরকার-সমর্থিত কয়েকটি গণমাধ্যম মাসা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
মাসার মৃত্যুর প্রভাব নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মোরতেজাই বলেন, ‘মাসার মৃত্যু ইরানজুড়ে ও কুর্দিস্তানে প্রতিবাদ আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠে। মাসা এই মুহূর্তে ইরানের মানুষের ক্ষোভের কণ্ঠস্বর।’
মাসা ইরানের সংখ্যালঘু কুর্দি সম্প্রদায়ের মেয়ে। এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে।
মোরতেজাই বলেন, মাসার পরিবার তাদের সহায়তা করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে তাঁর মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি এই মৃত্যুর জন্য ইরান সরকারের দায় নিশ্চিতেরও আরজি জানিয়েছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে গত সপ্তাহের শেষ দিকে সহিংসতা শুরুর পর থেকে ২৬ জন বিক্ষোভকারী এবং পুলিশ নিহত হয়েছে। অথচ বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৪১-এর মতো।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বলেছেন, যারা দেশের নিরাপত্তা ও শান্তির নষ্ট করবে, তাদের ইরান অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে মোকাবিলা করবে।
ইরানের নারীরা দেশের ইসলামিক ড্রেস কোডকে চ্যালেঞ্জ করে বিক্ষোভে বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। একদল নারী হিজাব উড়িয়ে ও পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অনেকে প্রকাশ্যে তাঁদের চুল কেটে ফেলেন। বিক্ষোভ থেকে উত্তাল জনতা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশ প্রধান হোসেন আশতারি এই বিক্ষোভ দমনে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে জনগণের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকে আসা নির্দেশের ভিত্তিতে যারা নাশকতা ও নিরাপত্তা বিঘ্ন করছে, তাদের জানা উচিত যে তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।’