ইসরায়েলের হামলায় অন্তঃসত্ত্বা মাসহ ৬০ স্বজন হারিয়েছে ১৬ মাসের মেলিসা
রাত তখন প্রায় চারটা। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমাবর্ষণের দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। মোবাইলে অনবরত ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙে ইয়াসমিন জুদাহর। কিছুটা অবাক হলেও বুঝতে পারেন, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গোটা পরিবার নিহত হওয়ার খবর পেয়ে সহানুভূতি জানাতে সবাই ফোন করছে।
আতঙ্কিত হয়ে অন্ধকারের মধ্যেই রাস্তায় ছুটে যান ইয়াসমিন জুদাহ। এরপর সোজা চলে যান তাঁর মা-বাবার বাড়িতে। কিন্তু বাড়িটি ততক্ষণে আর অবশিষ্ট নেই। আছে শুধু ধ্বংসস্তূপ। খালি হাতে কংক্রিটের স্তূপ সরাতে থাকেন তিনি।
ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে চারতলা বাড়িটি ধসে পড়ার সময় ইয়াসমিনের পরিবার ঘুমাচ্ছিল। ইয়াসমিন ছুটে এসে দেখেন বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন তাঁর কয়েক ডজন স্বজন। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে একের পর এক মরদেহ বের করা হচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে ইয়াসমিন অসহায়ভাবে চারপাশে তাকাচ্ছিলেন।
হঠাৎ চোখ আটকে যায় ১৬ মাস বয়সী মেলিসার ওপর। হাসিখুশি মেলিসা ইয়াসমিনের বোনের ছোট মেয়ে। কয়েক সপ্তাহ আগেই হাঁটতে শিখেছে। তাঁর নিথর দেহ দেখে সবাই ভেবেছিলেন সে আর বেঁচে নেই। ইসরায়েলের হামলায় তাঁর মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে। শিশুটির বুক থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে গেছে।
পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে এত বড় ধাক্কার কয়েক সপ্তাহ পরেও ইয়াসমিনের কণ্ঠ ছিল শোকার্ত। কথা বলতে গিয়ে তাঁর গাল বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরতে থাকে।
আল-আকসা মার্টায়ার্স হাসপাতালের (আল–আকসায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত হাসপাতাল) ভেতরে কথা হয় ইয়াসমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কেউ বেঁচে নেই। আমার পাঁচ ভাই-বোনকে হত্যা করা হয়েছে। মা, দুই আন্টি ও তাদের ছেলে-মেয়েদের এবং দুলাভাইকে হারিয়েছি। আমি তাঁদের ফিরে পেতে চাই। তাঁদের আমার কাছে নিয়ে আসুন।’
ইসরায়েলের হামলায় ইয়াসমিনের ৩২ জন নিকটাত্মীয় নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মেলিসার বাবা, তাঁর মা-বাবা ও বোনেরা এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা রয়েছেন। সব মিলিয়ে তাঁর বৃহত্তর পরিবারের ৬৮ জন নিহত হয়েছেন।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
মেলিসাকে জরুরিভিত্তিতে গাজার বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন বলে মনে করেন আল-আকসা হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের (হাড়ের চিকিৎসা) প্রধান আয়মান হার্ব। তিনি বলেন, তাঁর মেরুদণ্ডের ভেতরে ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরা রয়েছে। মেরুদণ্ডেও চিড় ধরেছে। অস্থিসন্ধিতে ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরার কারণে সে কখনোই শরীরের একেবারে নিচের অংশ নাড়াতে পারবে না।
আয়মান হার্ব আরও বলেন, ‘মেরুদণ্ড ও বুক থেকে নিচ পর্যন্ত অবশ হলেও ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে সুস্থসবল মনে হয়। কিন্তু তাঁর এখন ফিজিওথেরাপি ও মানসিক সহায়তা দরকার।’
হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান বলেন, মেলিসার শরীরে ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরা থাকায় সংক্রমণসহ নানা জটিলতার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে তাঁর শরীরের একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকেজো হতে পারে। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইয়ে নেই, এমন সব রোগীদের চিকিৎসা করছি আমরা। ইসরায়েলের হামলায় পক্ষাঘাতের শিকার হওয়া ১২ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে।’
মেলিসা সম্পর্কে জানতে চাইলে, তাকে নিয়ে তেমন কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি আয়মান হার্ব। তিনি বলেন, ‘মেলিসার জন্য চরম ভোগান্তি অপেক্ষা করছে। তাকে আজীবন হুইলচেয়ারে বসেই কাটাতে হবে।’
গাজার অন্যান্য হাসপাতালের মতো সীমিত জনবল ও সরঞ্জাম নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে আল-আকসা হাসপাতাল। জ্বালানিসংকটের কারণে এখন সৌরবিদ্যুতের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের ঘাটতি রয়েছে।
আল-আকসা হাসপাতাল গাজা নগরীর আল-শিফা হাসপাতালের মতো অত বড় নয়। দার আল-বালাহ শহরের জন্য গড়ে তোলা হাসপাতালটিতে মাত্র ১৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযানের পর হাসপাতালটিতে রোগীর চাপ বেড়েছে। শয্যার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে হাসপাতালটি।
হাসপাতালটির সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে আয়মান হার্ব বলেন, ‘হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগী দেখার পর আমাদের চোখের পানি ফেলারও সময় থাকে না। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত ৩০টি বড় অস্ত্রোপচার ও ১৫টি ছোট অস্ত্রোপচার করতে হয়।’
‘আমার সব শেষ গেছে’
মেলিসার মা ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের হামলার সময় তাঁর প্রসব শুরু হয়। পরে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় তাঁর পেট থেকে যমজ নবজাতকের মাথা বের হয়ে ছিল।
গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ১১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৮ হাজার নারী ও শিশু। গাজার উত্তরাঞ্চলে স্থল অভিযান জোরদার করার পর একের পর এক হাসপাতালে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
হাসপাতালগুলোতে হামলা জোরদারের পর গাজার যোগাযোগ ও পরিষেবাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। এ কারণে গত দুই দিন মৃত্যুর সংখ্যা হালনাগাদ করা যায়নি।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি শিশু।
ইসরায়েলের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষ এখনো নিখোঁজ। তাদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা ১ হাজার ৭০০।
মেলিসা এখন খালা ইয়াসমিনের সঙ্গে দার আল-বালাহতে আছে। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজা ছাড়ার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন ইয়াসমিন।
ইয়াসমিন বলেন, ‘আমি তাকে হৃদয়ে আগলে রাখব। সে ছাড়া আমার আর কেউ রইল না। আমি চাই সে যেন হাঁটতে পারে। তবে আমি জানি না সে কীভাবে বাঁচবে।’