সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নতুন মোড়
সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এর পাশাপাশি সেখানকার বিমানবন্দর ও আশপাশের বেশ কয়েকটি শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও আলেপ্পোর বেশির ভাগ অংশে বিদ্রোহীদের প্রবেশের কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সিরিয়ার সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিদ্রোহীরা বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। হামলা প্রতিহত করতে নতুন সেনা মোতায়েন করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা।
গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আসাদকে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। আসাদের পক্ষে তাঁর মিত্র রাশিয়া বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। আকস্মিক বিদ্রোহীদের হাতে আলেপ্পোর নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নতুন মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত বুধবার থেকে হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আকস্মিক হামলা শুরু করে। প্রায় এক দশক পর তারা সরকারনিয়ন্ত্রিত ছোট শহরগুলোর দখল নিতে থাকে এবং আলেপ্পোয় পৌঁছে যায়। আলেপ্পোর বেশির ভাগ বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেছে।
২০১৬ সালে বিদ্রোহীদের কাছ থেকে উত্তরাঞ্চলীয় এই নগরের পুনর্দখল নিয়েছিল প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাহিনী এবং তাঁর মিত্র রাশিয়া, ইরান ও আঞ্চলিক শিয়া বিদ্রোহীরা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের বরাত দিয়ে এএফপির খবরে বলা হয়েছে, সর্বশেষ এই লড়াইয়ে অন্তত ৩২৭ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই যোদ্ধা। তবে ৪৪ জন বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন। গত শনিবার দাবি করা হয়, নতুন করে হামলার পর আরও ১৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। নাগরিকদের নিরাপত্তায় বিদ্রোহীরা গতকাল রোববার বিকেল ৫টা পর্যন্ত আলেপ্পোয় কারফিউ জারি করে।
এইচটিএস একসময় নুসরা ফ্রন্ট নামে পরিচিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক এবং আরও কয়েকটি দেশ নুসরা ফ্রন্টকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা আলেপ্পোর পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনএসসি) এ তথ্য জানিয়েছে।
একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া (সংকটের সমাধানে) সিরিয়া সরকারের অনীহা এবং রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতার ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেছেন এনএসসির মুখপাত্র শন সাভেট। তিনি বলেন, সেটাই এখন প্রকাশ্যে আসছে, উত্তর–পশ্চিম সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনও এর অন্তর্ভুক্ত। এখন ‘নিষিদ্ধঘোষিত একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের’ নেতৃত্বে যে হামলা হচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু করার নেই বলেও বলেছেন সাভেট।
সিরিয়ায় ২০১১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই গৃহযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। তবে কয়েক বছর আগেই দেশটির বেশির ভাগ অংশে সংঘর্ষ থেমে গিয়েছিল। মিত্র ইরান ও রাশিয়ার সহায়তায় আসাদ বাহিনী সিরিয়ার বেশির ভাগ অংশ এবং সব বড় বড় নগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ২০১৬ সাল থেকে আলেপ্পো সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর দখলে ছিল।
শনিবার আলেপ্পোতে তোলা কয়েকটি ছবি প্রকাশ পেয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, লোকজন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রয়াত ভাই বাসিল আল-আসাদের উল্টে ফেলা মূর্তির সামনে ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছে। বিদ্রোহীদের ট্রাকে করে শহরময় ঘুরে বেড়ানোর ছবিও প্রকাশ পেয়েছে। আলেপ্পোর ঐতিহাসিক একটি দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তিকে সিরিয়ার বিরোধী দলের পতাকা ওড়াতে দেখা গেছে।
বিদ্রোহীদের হামলার মুখে সরকারি বাহিনী আলেপ্পো বিমানবন্দর থেকে সরে গেছে বলেও জানিয়েছে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস। সংস্থাটি থেকে বলা হয়েছে, ‘আলেপ্পো বিমানবন্দরের দখল নেওয়ার পাশাপাশি বিদ্রোহী বাহিনী বিনা বাধায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরের দখল নিয়েছে। বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে সিরিয়ার সেনাবাহিনী দেশটির চতুর্থ বৃহৎ নগর হামা থেকে সরে গেছে।’
তেহরান ও মস্কোনির্ভরতা
এইচটিএস মূলত আল-কায়েদার সাবেক সিরিয়া শাখার একটি জিহাদি জোট। এ জোটের মিত্রদের নিয়ে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমের ইদলিব অঞ্চলের বড় অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পর্যবেক্ষক সংস্থার প্রধান রামি আবদেল রহমান বলেন, এ মুহূর্তে মনে হচ্ছিল মস্কো প্রতীকী হামলা চালানোর আগপর্যন্ত সিরিয়া সরকারকে তাদের প্রধান মিত্র তেহরান ও মস্কো প্রত্যাখ্যান করেছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে আসাদ সরকারকে সহায়তায় আলেপ্পোতে বিমান হামলা চালানো হয়েছে। ফ্রান্সের পক্ষ থেকে সব পক্ষকে নাগরিক সুরক্ষা দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সিরিয়ার এ পরিস্থিতির জন্য মস্কো ও তেহরাননির্ভরতাকে দায়ী করা হয়েছে।
নেওয়া হবে যৌথ উদ্যোগ
আলেপ্পো পরিস্থিতি নিয়ে ইরান ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। রাশিয়া ও তেহরানের পক্ষ থেকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আলেপ্পো নিয়ে আলোচনার জন্য ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি দামেস্ক সফরে গেছেন। ২০২০ সাল থেকে বিদ্রোহীরা তুরস্ক ও রাশিয়ার করা একটি শান্তিচুক্তি মেনে চলছিলেন। এ নিয়ে ইরানের পক্ষ থেকে তুরস্কের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ তুরস্কের সঙ্গে মিলে যৌথ উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি আসাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সিরিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।