লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর ব্যবহার করা কয়েক হাজার পেজারের একযোগে বিস্ফোরণের ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সর্বাত্মক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা এসব যোগাযোগ যন্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে লেবাননের একটি জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা সূত্র এবং অন্য একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে। গত মঙ্গলবারের এ নজিরবিহীন বিস্ফোরণের ঘটনায় হিজবুল্লাহর সদস্যসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার।
পেজার বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ারও অঙ্গীকার করেছে তারা। আজ বুধবার এক বিবৃতিতে গোষ্ঠীটি বলেছে, প্রাণঘাতী পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চালিয়ে নেওয়ার দৃঢ়তাই কেবল বাড়াবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটায় এ নিয়ে ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর।
তবে এ বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। সাধারণত বিদেশের মাটিতে চালানো অভিযানের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে ইসরায়েল।
যেভাবে ঘটানো হয় বিস্ফোরণ
লেবাননের নিরাপত্তা সূত্র বলেছে, পেজারগুলো তাইওয়ানভিত্তিক গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানির। এ কোম্পানি থেকে পাঁচ হাজার পেজার কিনতে ক্রয়াদেশ দিয়েছিল হিজবুল্লাহ। চলতি বছরের শুরুর দিকে পেজারের চালানটি লেবাননে পৌঁছায়।
অবশ্য গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হসু চিং-কুয়াং বলেছেন, বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজে ব্যবহৃত পেজারগুলো তাঁর কোম্পানি উৎপাদন করেনি। এগুলো তৈরি করেছে ইউরোপীয় একটি প্রতিষ্ঠান। এটির তাইপেভিত্তিক গোল্ড অ্যাপোলোর ব্র্যান্ড ব্যবহারের অনুমতি ছিল।
তবে ইউরোপীয় কোম্পানিটির নাম তাৎক্ষণিকভাবে উল্লেখ করেননি কুয়াং। আজ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পণ্যটি (পেজার) আমাদের নয়। সেখানে (পণ্য) আমাদের ব্র্যান্ডের নামটি বসানো হয়েছে শুধু।’
লেবাননের একটি জ্যেষ্ঠ সূত্র বলেছে, উৎপাদন পর্যায়েই পেজারগুলোয় পরিবর্তন (মডিফাই) এনেছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। একই সূত্র বলেছে, যন্ত্রের (পেজার) ভেতরে একটি বোর্ড ঢুকিয়ে দিয়েছিল মোসাদ। এই বোর্ডে বিস্ফোরক উপাদান ছিল। এর একটি সাংকেতিক ভাষা গ্রহণের ক্ষমতা ছিল। যেকোনোভাবেই হোক, এটি শনাক্ত করা খুব কঠিন। এমনকি কোনো যন্ত্র বা স্ক্যানার দিয়েও শনাক্ত করা যায় না।
সূত্রটি বলেছে, যে তিন হাজার পেজার বিস্ফোরিত হয়েছে, সেগুলোতে বিস্ফোরণের আগে সাংকেতিক বার্তা পাঠানো হয়েছিল। এ কারণে বিস্ফোরকগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আরেকটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, নতুন পেজারগুলোর মধ্যে তিন গ্রাম পর্যন্ত বিস্ফোরক লুকানো ছিল। কয়েক মাসেও হিজবুল্লাহ তা শনাক্ত করতে পারেনি।
হিজবুল্লাহর নিজস্ব তদন্তের বরাত দিয়ে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের যোগাযোগ যন্ত্র সরাসরি লেবাননে আনার অনুমতি ছিল না। ফলে পার্শ্ববর্তী একটি পোতাশ্রয়ে সেগুলো প্রায় তিন মাস পড়ে ছিল। ওই সময় এসব পেজারে বিস্ফোরক বসানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল মোসাদ।
সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা
গত ৭ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। গত জুলাইয়ের শেষ দিকে হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শোকরকে বৈরুতের উপকণ্ঠে হামলা চালিয়ে হত্যা করে ইসরায়েল। এ নিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত সীমিত আকারে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত দেয় হিজবুল্লাহ।
তবে পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায় এ দফায় সর্বাত্মক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো মোহান্নাদ হজ আলী বলেন, হিজবুল্লাহ সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়াতে চায়। এখনো তারা এমন একটি যুদ্ধ এড়াতে চাইছে। তবে এ (পেজার) হামলার ব্যাপকতা—যেমন পরিবারগুলো ও সাধারণ মানুষের ওপর পড়া প্রভাব, শক্ত জবাব দেওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ বাড়াবে।
বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ বলেছে, গাজার সমর্থনে, এর জনগণের সমর্থনে অন্য দিনগুলোর মতো আজও প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। তাদের এ অভিযান মঙ্গলবারের হত্যাযজ্ঞের জবাব পেতে সময় গুনতে থাকা অপরাধী শত্রুকে (ইসরায়েল) যে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে, তা থেকে আলাদা।
এর আগে গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, হিজবুল্লাহর সঙ্গে অচলাবস্থা নিরসনে কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিক যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, পেজার বিস্ফোরণের বিষয়ে আগাম জানত না যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে সংঘাত উসকে দেয়—এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে সব পক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে আজ মিসরে অবস্থানকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির বিষয়টি এখন রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।