ইরানের ‘নীতি পুলিশ’ কারা, তাদের কাজ কী
ইরানের রাজধানী তেহরানে ‘নীতি পুলিশের’ হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির (২২) মৃত্যু দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। দেশটির শহরে শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। সপ্তাহখানেক ধরে চলা বিক্ষোভ-সহিংসতায় ৪০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। মাসার মৃত্যুর ঘটনায় দেশ-বিদেশে এখন আলোচনায় ইরানের ‘নীতি পুলিশ’।
‘যথাযথ নিয়ম’ মেনে হিজাব না পরার অভিযোগে মাসাকে তেহরানে আটক করেছিল ‘নীতি পুলিশ’। আটকের পর ‘নীতি পুলিশের’ হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে তেহরানের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ সেপ্টেম্বর মাসার মৃত্যু হয়।
ইরানের বহুল আলোচিত এই ‘নীতি পুলিশ’ (মোরালিটি পুলিশ) কী, কী তার কাজ, সে সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ইরানের ‘নীতি পুলিশ’ মূলত ফারসি ‘গাতে-ই এরাদ’ বা ‘গাইডেনস প্যাট্রোল’ নামে পরিচিত। তাদের কাজ হলো, ইরানের কঠোর পোশাকবিধি অমান্যকারী ব্যক্তিদের আটক করে ব্যবস্থা নেওয়া।
‘নীতি পুলিশ’ ইরানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত। ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ঠিক করা ইসলামি নীতি-নৈতিকতা মানুষ মানছে কি না, তা তারা নিশ্চিত করে।
‘নীতি পুলিশের’ প্রতিটি ইউনিটে একটি করে ভ্যান আছে। এই ভ্যানগাড়িতে ‘নীতি পুলিশের’ নারী ও পুরুষ উভয় সদস্যরা থাকেন। তাঁরা ব্যস্ত জনপরিসরে টহল দেন। অপেক্ষা করেন। কেউ যথাযথ আচরণ না করলে, যথাযথ পোশাক না পরলে তাঁরা তাঁদের ধরেন।
যাঁরা ‘নীতি’ লঙ্ঘন করেন, তাঁদের সতর্ক করে নোটিশ দেয় নীতি পুলিশ। আবার কিছু ক্ষেত্রে নীতি লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকে আটক করে থানা বা সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে গিয়ে তাঁদের কীভাবে পোশাক পরতে হবে, কী নৈতিক আচরণ করতে হবে, সে বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। পরে পুরুষ অভিভাবকদের ডেকে তাঁদের জিম্মায় আটক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
‘নীতি পুলিশ’ কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিদের জরিমানা করে। তবে জরিমানার ক্ষেত্রে কোনো সাধারণ নিয়ম নেই।
ইরানের শরিয়া আইন অনুযায়ী, নারীদের মাথা ও চুল ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক। তাঁদের এমন লম্বা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে, যাতে শরীরের গঠন বোঝা না যায়।
ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব হয়। এই বিপ্লবের কয়েক দশক পরও দেশটির ধর্মীয় নেতারা পোশাকসংক্রান্ত নিয়মনীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
ইরানে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণির অনেক নারী আঁটসাঁট পোশাক পরেন। তাঁরা ঊরু-সমান দৈর্ঘ্যের কোট পরেন। তাঁরা এমনভাবে উজ্জ্বল রঙের স্কার্ফ পরেন, যাতে মাথার অনেক চুল বেরিয়ে থাকে।
‘বাসিজ’ নামে ইরানে একটি আধা সামরিক বাহিনী রয়েছে। গত শতকের আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় শুরুতে এই আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্মুখ সমরে পাঠানো হয়েছিল। দেশটির ‘নীতি পুলিশ’ এই আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে গঠিত হয়। এ ছাড়া ‘নীতি পুলিশকে’ সাহায্য-সহযোগিতাও করে বাসিজ।
ইরানের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসিজের উপস্থিতি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পোশাক ও আচরণ নজরদারি করে বাসিজ। ইরানে বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে নারী ও পুরুষ একসঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ পান।
ইতিহাস
ইরানের ইসলামি বিপ্লব নারীদের রক্ষণশীল পোশাক পরার বিষয়টিকে অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে কঠোর হিজাববিধি নিয়ে সেই সময় থেকেই দেশটিতে একটি বিরোধ আছে।
ইসলামি বিপ্লবের শুরুর বছরগুলোয় ধীরে ধীরে নারীদের ইসলামিক পোশাক পরার জন্য নিয়ম আরোপ করে রাষ্ট্র।
ইরানে ইসলামি বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তিনি ছিলেন হিজাবের পক্ষে। তাই বিপ্লবীরা তাঁদের নেতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশটির সড়কে যথাযথ পোশাক না পরা নারীদের ওপর চড়াও হতেন।
পরে নারীদের পোশাক পরার বিধি নিয়ে দেশটির ধর্মীয় নেতা ও মন্ত্রীদের তৈরি একাধিক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এসব বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারি অফিসে কোনো নারী হিজাব ছাড়া যেতে পারবেন না। এ নিয়ে ১৯৮৩ সালে একটি আইন করা হয়। আইনে যেসব নারী ‘পর্দা’ করবেন না, তাঁদের ৭৪টি দোররা মারার বিধান রাখা হয়।
সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ খাতামির সময় দেশটির জনপরিসরে নারীদের পোশাক ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে এসব নিয়ম-নীতি কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৫ সালে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ‘শুদ্ধতার সংস্কৃতি বিকাশের কৌশল’ নামে নতুন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে দেশটির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সর্বোচ্চ কাউন্সিল।
খাতামির পর ইরানের প্রেসিডেন্ট হন মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। তিনি অতিরক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সময় ইরানের ‘নীতি পুলিশের’ নাম রাখা হয় ‘গাতে-ই এরাদ’। মাহমুদ আহমাদিনেজাদের শাসনামলে দেশটির বড় বড় শহরের সড়কে এই বাহিনীর উপস্থিতি অনেক বেড়ে যায়।
‘নীতি পুলিশের’ প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা ইরানে ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় অন্যতম বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। সংস্কারপন্থী প্রার্থীরা এই বাহিনী বিলোপের দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু ‘নীতি পুলিশ’ বিলুপ্তে শেষ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং নানা সময়ে ‘নীতি পুলিশের’ কঠোর ব্যবস্থার ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসে।