স্বার্থের সম্পর্কে হালকা টানাপোড়েন
জো বাইডেন তখনো প্রেসিডেন্ট হননি। নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত তিনি। তাঁর প্রতিপক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্প। সৌদি আরবের প্রতি তাঁর বিশেষ ‘দুর্বলতা’ সবার জানা। নির্বাচনে ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করার কৌশলের অংশ হিসেবে ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার পর্বে বাইডেন সৌদির মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশটির শাসকদের বিরুদ্ধে সরব হন। বাইডেন ঘোষণা দেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে সৌদির সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করবেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বাইডেন তাঁর সরকারের যেসব নীতির কথা জোর গলায় ঘোষণা দেন, তা ছিল স্পষ্টত সৌদির জন্য প্রতিকূল। এমনকি তিনি সৌদির ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও খাসোগি হত্যা নিয়ে গোপন গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। খাসোগি হত্যার মিশনে সৌদির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সরাসরি অনুমোদন ছিল বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে আসে। খাসোগি হত্যার ‘নির্দেশদাতা’ সৌদির যুবরাজের সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানান বাইডেন।
বাইডেনের এমন কঠোর মনোভাবে সবাই ভাবতে বসেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের সৌদি নীতিতে এবার বুঝি বদল আসছে। রিয়াদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সুর হয়তো কেটে যাচ্ছে।
সেই বাইডেনকেই গত জুলাই মাসে দেখা গেল এক ভিন্ন রূপে। ঘরে-বাইরে তীব্র সমালোচনা উপেক্ষা করে তিনি যান সৌদিতে। সেখানে গিয়ে দেন এক ‘চমক’। তিনি দেশটির কার্যত শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে ‘ফিস্ট বাম্প’ করেন।
আসলে তখন বাইডেন সৌদি গিয়েছিলেন স্বার্থ হাসিলের জন্য। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে তেলের জন্য সৌদিকে খুব দরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। তাঁর সৌদি সফরে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুসহ তেলের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। এমনকি তখন সমালোচকেরা বলাবলি করছিলেন, সৌদির তেলের কাছে বিক্রি হয়ে গেল বাইডেন প্রশাসন।
সৌদির নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাস সম্প্রতি অপরিশোধিত তেল উৎপাদন দিনে ২০ লাখ ব্যারেল কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জোটে রাশিয়াও আছে। ওপেক প্লাসের এমন সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নিশ্চিত ধাক্কা। কারণ, সরবরাহ কমলে তেলের দাম বাড়বে। ইতিমধ্যে তেলের দাম চড়তেও শুরু করেছে।
আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন। কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে বাইডেন ও তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য এ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রে তেলের দাম বাড়ুক, মূল্যস্ফীতি আরও নাজুক পরিস্থিতিতে যাক, তা কোনোমতেই চান না বাইডেন।
তা ছাড়া ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তটি রাশিয়ার পক্ষে গেছে। ইউক্রেনে হামলার জেরে তেলের দিক থেকে রাশিয়াকে দমানোর যে চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা করে আসছে, ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তে তা হোঁচট খেতে পারে। এ বিষয়ও বাইডেনকে ক্ষুব্ধ করেছে।
সৌদির ওপর চটে বাইডেন প্রকাশ্যে বলেছেন, রিয়াদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তের জন্য সৌদিকে পরিণতি ভোগ করতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
সৌদি আরব পাল্টা জবাব দিয়েছে। তারা বলেছে, মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তটি এক মাসের জন্য স্থগিত করতে বলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এ অনুরোধ রাখা হলে তা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সৌদিকে কীভাবে বাইডেন প্রশাসন শায়েস্তা করতে পারে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নানা আলোচনা চলছে। এসব আলোচনায় সামনে আসছে নানা বিকল্প।
যেমন সৌদি আরবে পেন্টাগন যে নতুন সামরিক পরীক্ষাগার গড়ার পরিকল্পনা করছে, তা স্থগিত করা হতে পারে। তেলের দামের ওপর ওপেক সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ ভাঙতে যুক্তরাষ্ট্র ‘নোপেক’ বিল পাস করাতে পারে। সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি থেকে মার্কিন সেনা যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহার করতে পারে। রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করা যেতে পারে।
ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব হুমকি দিচ্ছে, তাকে অবশ্য ভিন্নভাবে দেখছে সৌদি আরব।
রিয়াদ মনে করছে, মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে ডেমোক্র্যাট শিবির রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য সৌদিকে হুমকি দিচ্ছে। নির্বাচনের মৌসুমে অনেক কথা বলা হয়। অনেক কিছু করা হয়। কিন্তু পরে তার আর কোনো বাস্তবতা থাকে না। সৌদিও এখন তেমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিভিউ সাময়িকীর জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিবেদক জিম জেরাগথির মতে, সৌদির প্রতি বাইডেন প্রশাসনের বর্তমান নীতি কী, তা বলা কঠিন।
বাস্তবিক অর্থেই বাইডেন প্রশাসন যদি সৌদির বিরুদ্ধে কঠিন কোনো ব্যবস্থা নেয়, তা ওয়াশিংটনের জন্য ‘বুমেরাং’ হতে পারে।
ওয়াশিংটন যদি রিয়াদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র বিক্রেতা। দেশটির অস্ত্রের বড় ক্রেতা সৌদি। আবার রিয়াদকে দূরে ঠেলে দিলে তারা মস্কোর দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। সৌদি আরব থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিলে অঞ্চলটিতে একটা শূন্যতা তৈরি হবে। এ শূন্যতা পূরণ করতে পারে ইরান, রাশিয়া, চীন।
সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আট দশকের অংশীদারত্বের সম্পর্ক। এ সম্পর্কের মূলে রয়েছে স্বার্থ। এ স্বার্থের কারণেই রিয়াদের ব্যাপারে বাইডেন হুট করে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে হয় না। বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের কথায় তার ইঙ্গিত মেলে। তিনি বলেছেন, সৌদির ব্যাপারে বাইডেন বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তথ্যসূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স