নীতি পুলিশের হেফাজতে মাসা আমিনি নামের ২২ বছরের এক তরুণীর মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভে উত্তাল ইরান। বিক্ষোভ ঠেকাতে নিরাপত্তাকর্মীরা সহিংস পথ বেছে নিয়েছেন।
ইরানের কঠোর পর্দাবিধি লঙ্ঘনের অপরাধে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করে দেশটির নীতি পুলিশ। এরপর পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু হয়। মানবাধিকার সংস্থা বলছে, বিক্ষোভের তিন সপ্তাহে দেশটিতে ১৫০ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
বিক্ষোভকারীদের দমন–পীড়নের সিদ্ধান্ত এসেছে ইরানের ক্ষমতাধরদের নির্দেশে। ক্ষমতাধরেরা এই বিক্ষোভকে একধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে ইরানে সবচেয়ে ক্ষমতাধর কে, তার একটি ধারণা তুলে ধরা হয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ক্ষমতা কেমন
১৯৮৯ সাল থেকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি দেশটির প্রধান ও কমান্ডার ইন চিফ। দেশটির সরকারি পুলিশ ও নীতি পুলিশের কর্তৃত্ব রয়েছে খামেনির হাতে। এই নীতি পুলিশই গ্রেপ্তার করে মাসা আমিনিকে। তাদের হেফাজতেই মৃত্যু হয় মাসার।
ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) নিয়ন্ত্রণও আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির হাতে। আইআরজিসির দায়িত্ব ইরানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করা।
আইআরজিসির স্বেচ্ছাসেবক শাখা বাসিজ রেজিসট্যান্স ফোর্স। বাসিজেরও প্রধান হলেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। বাসিজ বারবার ইরানে ভিন্নমত প্রকাশ দমন করেছে। বিক্ষোভকারীদের কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে বিষয়েও নির্দেশনা আসে খামেনির কাছ থেকে।
প্রেসিডেন্ট কী বলেছেন
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি শীর্ষ নির্বাচিত কর্মকর্তা। সর্বোচ্চ নেতার পরেই তাঁর অবস্থান। সরকারের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব রাইসির ওপর। ইরানের অভ্যন্তরীণ নীতি ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তবে তাঁর ক্ষমতাও বিশেষ করে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে সীমিত।
প্রেসিডেন্ট রাইসির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানের সরকারি পুলিশ বাহিনী পরিচালনা করে। বিক্ষোভ দমনে এই পুলিশ বাহিনী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তবে পুলিশের কমান্ডার নিয়োগ দেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। আর কমান্ডারকে সরাসরি সর্বোচ্চ নেতার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। ইসলামিক রেভল্যুশন গার্ড কর্পস ও বাসিজের কমান্ডারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এর অর্থ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা যদি বাহিনীর মাধ্যমে বিক্ষোভ দমন করতে চান, তাহলে প্রেসিডেন্টের সে পথে চলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না।
ইরানের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আবার যাচাই করা হয় পার্লামেন্টের মাধ্যমে। পার্লামেন্ট নতুন আইন প্রণয়ন করে। আবার এই গার্ডিয়ান কাউন্সিলে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মিত্ররা থাকেন। এই কাউন্সিল নতুন আইন অনুমোদন করতে পারে ও ভেটো দিতে পারে।
নীতি পুলিশ কারা
২০০৫ সালে নীতি পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাহিনী ইসলামিক নৈতিকতা ও আইন সমুন্নত রাখতে যথাযথ পোশাকের বিধির বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক রেভল্যুশনের পর এই আইন প্রবর্তিত হয়। নীতি পুলিশ বাহিনীতে সাত হাজার পুরুষ ও নারী কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের জরিমানা ও সন্দেহভাজনদের আটক করার ক্ষমতা রয়েছে নীতি পুলিশের।
এই গ্রীষ্মকাল থেকে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি দেশটিতে হিজাববিধি বলবৎ করতে বেশ কিছু নতুন ব্যবস্থা চালু করেছেন। হিজাববিধি না মেনে চলা নারীদের চিহ্নিত করতে নজরদারি ক্যামেরা চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিজাবনীতির বিরোধিতাকারীদের জন্য বাধ্যতামূলক কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রেভল্যুশন গার্ড কারা
ইরানের রেভল্যুশন গার্ড দেশের ইসলামি ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখতে বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরানের অন্যতম প্রধান সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাহিনী হলো এই আইআরজিসি। এই বাহিনীতে ১৫ হাজারের বেশি সদস্য রয়েছেন। এই বাহিনীর নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী রয়েছে। ইরানের কৌশলগত অস্ত্রেরও তত্ত্বাবধান করে এই বাহিনী।
আইআরজিসির কুদস ফোর্স নামে বিদেশি একটি বাহিনী রয়েছে। এই কুদস ফোর্স গোপনে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মিত্রদের অর্থ, অস্ত্র, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দেয়। বাসিজ রেজিসট্যান্স ফোর্সকেও নিয়ন্ত্রণ করে এই বাহিনী।
বাসিজ কী
দ্য বাসিজ রেজিসট্যান্স ফোর্স আনুষ্ঠানিকভাবে অর্গানাইজেশন ফর দ্য মোবিলাইজেশন অব দ্য অপ্রেসড নামে পরিচিত। ১৯৭৯ সালে স্বেচ্ছাসেবী আধা সামরিক সংস্থা হিসেবে এটি গঠিত হয়। ইরানের প্রতিটি প্রদেশ ও শহরে বাসিজের শাখা রয়েছে। দেশটির অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানেও বাসিজের শাখা রয়েছে।
বাসিজের নারী ও পুরুষ সদস্যরা ‘বাসিজিস’ নামে পরিচিত। তাঁরা আইআরজিসির অধীনে কাজ করেন। প্রায় এক লাখ সদস্য অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন বলে ধারণা করা হয়।
২০০৯ সালে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনে জড়িত রয়েছেন বাসিজের সদস্যরা।