জ্বালানি তেলের দাম কমায় পেছাচ্ছে সৌদি যুবরাজের উচ্চাভিলাষী নিওম প্রকল্প
‘তাঁরা এমনটা বলতেই পারেন। আর আমরা যেটা পারি, তা হলো তাঁদের ভুল প্রমাণ করা।’
কথাটা সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের। সমালোচকদের উদ্দেশে তিনি এমন কথা বলেছিলেন। সময়টা ২০২৩ সালের জুলাই। টেলিভিশনে একটি তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়েছিল। তাতে মোহাম্মদ বিন সালমানের কাছে সৌদি আরবজুড়ে চলমান বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের ‘ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পগুলো’ নিয়ে সমালোচকদের সংশয়ের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তখন তিনি এই জবাব দিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ বিন সালমানের সেই জবাবের এক বছরও পেরোয়নি। কিন্তু সমালোচকদের সংশয় ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ পেতে শুরু করেছে।
২০৩০ সালের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা একটু বেশি উচ্চাভিলাষী ছিল
সৌদি আরবে এসব নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে ‘ভিশন ২০৩০’ রূপকল্পের আলোকে। দেশটির হবু বাদশাহ মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী রূপকল্প এটা। এর আলোকেই ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের আর্থসামাজিক খোলনলচে বদলে ফেলতে চান তিনি। সেই সঙ্গে দেশটির জ্বালানি তেলনির্ভর অর্থনীতিকেও বদলে ফেলতে চান মোহাম্মদ বিন সালমান।
তবে বিগত কয়েক মাসে সৌদি আরব সরকার উচ্চাভিলাষী ও বিস্তৃত মরুভূমি উন্নয়ন প্রকল্প (নিওম নামে পরিচিত) পরিকল্পনা পিছিয়ে দিয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন–২০৩০–এর মূল কেন্দ্রে রয়েছে এই প্রকল্প।
নিওম ছাড়া আরও ১৩টি বেশ বড় আকারের নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সৌদি আরব সরকার। ট্রিলিয়ন ডলারের এসব প্রকল্পকে ‘গিগা প্রজেক্ট’ বলা হচ্ছে। এর আওতায় রাজধানী রিয়াদের উপকণ্ঠে আস্ত একটি বিনোদন শহর এবং লোহিত সাগরের পাশে কয়েকটি বিলাসবহুল দ্বীপসহ বিভিন্ন পর্যটক ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম কম যাওয়ায় সৌদি আরবের রাজস্বে প্রভাব পড়েছে। আর এই পরিস্থিতি উচ্চাভিলাসী অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোর রাশ টানতে রিয়াদকে বাধ্য করছে। তবে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যাতে নির্বিঘ্ন রাখা যায়, সে জন্য অর্থায়নের বিকল্প কৌশলের সন্ধান করছে সৌদি সরকার।
জ্বালানি তেলের কম দাম সৌদি আরবের রাজস্বে প্রভাব ফেলছে। আর এই পরিস্থিতি উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোর রাশ টানতে রিয়াদকে বাধ্য করছে। তবে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যাতে নির্বিঘ্ন রাখা যায়, সে জন্য অর্থায়নের বিকল্প কৌশলের সন্ধান করছে সৌদি সরকার।
সরকারি এসব প্রকল্পের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত একজন উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, বড় বড় প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। শিগগিরই এ–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
ওই উপদেষ্টা আরও বলেন, কয়েকটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পগুলো নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো সন্দেহ নেই, এসব প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু কাজ এগোবে। তবে কিছু কাজ বিলম্ব হতে পারে। কিংবা কাজের পরিধি কাটছাঁট করা হতে পারে।
নিওম প্রকল্পের ঘোষণা আসে ২০১৭ সালে। বলা হয়, ৫০ হাজার কোটি ডলারের প্রকল্পটির আওতায় সৌদি আরবের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের মরু এলাকায় ১০টি ভবিষ্যৎ শহর গড়ে তোলা হবে।
নিওমসহ বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থের জোগান বাড়ানো সৌদি আরবের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে। শহরগুলো ১৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হবে। বসবাস করতে পারবেন ৯০ লাখ মানুষ। তবে প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আপাতত ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ২ দশমিক ৪ কিলোমিটারের কাজ শেষ করার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমেও এমন ভাবনার কথা ফাঁস হয়েছে।
ঘোষণা দেওয়ার সময় এটিকে ‘কার্বনমুক্ত লিনিয়ার শহর’ হিসেবে বলা হয়েছিল। এতে থাকবে পার্ক, জলপ্রপাত, উড়ন্ত ট্যাক্সি, রোবটের গৃহকর্মীসহ নানা আধুনিক সুযোগ–সুবিধা, যা শহুরে জীবনকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।
এসব শহরে থাকবে না কোনো সড়ক। থাকবে না প্রাইভেট কার। এরপরও শহরজুড়ে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক হবে বিস্তৃত ও সাবলীল। শহরে থাকবে অতি উচ্চগতির ট্রেন। সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের মধ্যে শহরের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছানো যাবে। তবে প্রথম পর্যায়ে এসব সুবিধার কী কী থাকছে, সেটা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি।
নিওম প্রকল্পের আওতায় একটি ভাসমান শিল্পশহর এবং পাহাড়ি এলাকায় একটি স্কি রিসোর্ট নির্মাণের কথা রয়েছে। ওই রিসোর্টে ২০২৯ সালে শীতকালীন এশিয়ান গেমস আয়োজন করতে চায় সৌদি আরব।
সাবেক ব্যাংকার ও নিওম প্রকল্পের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আলী শিহাবি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা একটু বেশি উচ্চাভিলাষী ছিল।
প্রকল্পটির মোট ব্যয় (৫০ হাজার কোটি ডলার) সৌদি আরবের এক বছরের জাতীয় বাজেটের ৫০ শতাংশ বেশি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অর্থে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। পুরো প্রকল্প শেষ করতে ২ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সৌদি আরব বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ। এরপরও ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে দেশটির জাতীয় বাজেট ঘাটতিতে চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ন্যায্য রাখতে উত্তোলন কমাতে হয়েছে দেশটিতে। এর প্রভাব পড়েছে বাজেটেও। সৌদি আরবের সরকার ধারণা করছে, এ বছর জাতীয় বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক প্রধান টিম চ্যালেন এখন আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। টিম বলেন, নিওমসহ বড় অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থের জোগান বাড়ানো (পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড) সৌদি আরবের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন উপসাগরীয় এই দেশ নানা উপায়ে অর্থের জোগান বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ জন্য চলতি মাসের শুরুতে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকোর বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
সৌদি আরব বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ। এরপরও ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে দেশটির জাতীয় বাজেট ঘাটতিতে চলছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ন্যায্য রাখতে উত্তোলন কমাতে হয়েছে দেশটিতে। এর প্রভাব পড়েছে বাজেটেও। সৌদি আরবের সরকার ধারণা করছে, এ বছর জাতীয় বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারে।
এ ছাড়া জ্বালানি তেলের উত্তোলন সীমিত রেখে দরপতন ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ওপেক প্লাস জোটের দেশগুলো। এ জন্য জ্বালানি পণ্যটির দৈনিক উত্তোলন ১০ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত স্বেচ্ছায় কমিয়ে এনেছে রিয়াদ। আগামী অক্টোবর থেকে উত্তোলন বাড়াতে পারে দেশটি।
আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ৯৬ দশমিক ২০ ডলারে উন্নীত হলে সৌদি আরবের বাজেটে ভারসাম্য ফিরতে পারে। কিন্তু এই দাম এখন ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের আশপাশে রয়েছে।
মেগা প্রকল্পগুলোয় অর্থায়নে সরকারি বন্ড বিক্রি করছে সৌদি আরবের সরকার। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ নেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। বেসরকারি কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে কষ্টসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে রিয়াদ।
আইএমএফের সাবেক প্রধান টিম বলেন, বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারছেন না, তাঁদের লগ্নির অর্থ আসলে কোথা থেকে ফেরত আসবে। তাই, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁরা দ্বিধান্বিত হয়ে রয়েছেন।
আমরা অবশ্যই পরিবর্তন (পরিকল্পনায়) আনব। কিছু প্রকল্প বিস্তৃত হবে। কিছু প্রকল্পের পরিধি কমিয়ে আনা হবে। আবার কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন তরান্বিত করা হবে
গত এপ্রিলে রিয়াদে একটি বিশেষ বৈঠক করে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম। বৈঠকে সৌদি আরবের অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আল–জাদান বলেন, বর্তমানে সৌদি সরকার কোনো ‘ইগো’ দেখাবে না। বরং ভিশন–২০৩০ বাস্তবায়নে অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে অর্থনীতিকে যেভাবে বদলানো দরকার, সেভাবেই বদলে ফেলা হবে।
মেগা প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোহাম্মদ আল–জাদান আরও বলেন, ‘আমরা অবশ্যই পরিবর্তন (পরিকল্পনায়) আনব। কিছু প্রকল্প বিস্তৃত হবে। কিছু প্রকল্পের পরিধি কমিয়ে আনা হবে। আবার কিছু প্রকল্পের বাস্তবায়ন তরান্বিত করা হবে।’
অনুবাদ করেছেন: অনিন্দ্য সাইমুম