হামাসের উপপ্রধান হত্যায় মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন হামাস নেতা সালেহ আল-আরৌরি। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র এই গোষ্ঠীর উপপ্রধান ছিলেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় গাজার যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ সংঘাতের পরিসর যাতে পুরো অঞ্চলে না ছড়ায়, সে জন্য সব পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ ও ফ্রান্স।
সালেহ আল-আরৌরি হামাসের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ পলিটব্যুরোর একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য ছিলেন। বৈরুতের উপকণ্ঠে ইসরায়েলি ওই ড্রোন হামলায় সালেহ ছাড়াও আরও ছয়জন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল এ হামলার দায় স্বীকার করেনি। সাধারণত ইসরায়েল এসব হামলার দায় স্বীকার করে না।
ফিলিস্তিনের গাজায় প্রায় তিন মাস ধরে টানা নির্বিচার বোমা হামলা করছে ইসরায়েল। তবে তা এখন আর শুধু গাজায় আটকে নেই। গাজা ছাড়াও ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরেও ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সহিংসতা চলছে। এ যুদ্ধের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েলের লেবানন সীমান্ত, ইরাক ও সিরিয়াতে। স্থলভাগ ছাড়াও লোহিত সাগরে ইসরায়েলি জাহাজ নিশানা করে হামলার ঘটনা ঘটছে।
বৈরুতে যেভাবে হামাসের একজন শীর্ষ নেতাকে হত্যা করল ইসরায়েল, তাতে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে হামাসের মিত্র হিসেবে পরিচিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। এখন হামলা পাল্টা হামলা চললেও তা অত তীব্র নয়।
ইউনাইটেড নেশনস ইন্টেরিম ফোর্স ইন লেবাননের (ইউএনআইএফআইএল) একজন মুখপাত্র বলছেন, সংঘাতের পরিসর আরও বাড়লে ‘ব্লু লাইনের’ দুই প্রান্তের মানুষ এর পরিণতি ভোগ করবে। ইসরায়েল ও গোলান মালভূমি থেকে লেবাননকে পৃথককারী রেখা হলো ব্লু লাইন।
ইউএনআইএফআইএলের মুখপাত্র কেনদিজ আরদিয়েল আরও বলেন, ‘আমরা সব পক্ষকেই অস্ত্র ছেড়ে সংঘাত থেকে সরে আসার জন্য অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে প্রভাবশালী যেকোনো পক্ষকে তাদের প্রভাব খাটিয়ে সব পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানাতে অনুরোধ করছি।’
এদিকে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গান্টজের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। যেকোনো সংঘাতমূলক আচরণ থেকে বিশেষত লেবাননের সঙ্গে সংঘাত থেকে বিরত থাকতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈরুতের এ হামলা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে পাল্টাপাল্টি হামলার উসকানি দিয়েছে। ফলে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো যতই সংযত থাকার আহ্বান জানাক না কেন, মধ্যপ্রাচ্যে অদূর ভবিষ্যতে সংঘাতের বিস্তার কেউ ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না।
খবর জানা যাচ্ছে, সালেহ আল-আরৌরিকে হত্যার ঘটনাটি নিয়ে কেউ যাতে মুখ না খোলেন এ ব্যাপারে ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, ‘যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আছে।’
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, সালেহ আল-আরৌরির এ হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধযোদ্ধাদের শিরায় নতুন করে প্রতিরোধের স্পৃহা জাগিয়ে তুলবে। একই সঙ্গে দখলদার ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও তাঁরা বেশি অনুপ্রাণিত বোধ করবেন।
আরৌরির মৃত্যুতে দেওয়া শোকবার্তায় হামাসের পলিটব্যুরোর সদস্য হুমাস বাদরান বলেন, ‘অপরাধী দখলদারদের বলছি, তোমাদের সঙ্গে আমাদের লড়াই সব জায়গায় চলবে।’
হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে বলেছেন, আরৌরির মৃত্যু হামাসকে আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী ও নিজেদের সংকল্পে আরও বেশি বলীয়ান করে তুলেছে। যাঁরা চলে গেছেন, তাঁরা রেখে গেছেন শক্তিশালী উত্তরসূরি। উত্তরসূরিরা তাঁদের পতাকা বহন করে নিয়ে যাবেন।
আঞ্চলিক যুদ্ধ
মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতির কথায়। মঙ্গলবার তিনি সতর্ক করে বলেছেন, রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা তাঁর দেশকে যুদ্ধে টেনে নেওয়ার একটি চেষ্টার নামান্তর।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈরুতে হামলা করে বড় ধরনের অপরাধ করেছে ইসরায়েল। লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে প্রতিদিন হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। বৈরুতে হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল যে লেবাননকে নতুন করে সংঘাতে জড়াতে চাইছে, এ হামলায় তা খুব স্পষ্ট।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর ইসরায়েল সীমান্তে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে হিজবুল্লাহর নিয়মিত পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। তবে সেসব হামলার মাত্রা অতটা বড় পরিসরে ছিল না। সেখানে বৈরুতে ড্রোন হামলা চালিয়ে আরৌরির হত্যাকাণ্ড দুই পক্ষের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি তৈরি করেছে।
লেবাননের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদার্লাহ বৌ হাবিব বিবিসিকে জানিয়েছেন, আরৌরি হত্যার পর হিজবুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে তাঁর সরকার। আরৌরি হত্যার বদলা নেওয়া থেকে যাতে বিরত থাকে, সেই ব্যাপারে হিজবুল্লাহকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে।
তবে সবকিছু নির্ভর করছে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহর ওপর। আজ বুধবার বৈরুতে এক সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার কথা তাঁর। এই সমাবেশে তিনি কী প্রতিক্রিয়া জানান, তা নিয়েই চলছে আলোচনা। তবে এর আগে তিনি লেবাননের মাটিতে গুপ্তহত্যা চালানোর ব্যাপারে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছিলেন। হাসান নাসরাল্লাহ এ নিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন, এ রকম কিছু হলে চরম প্রতিক্রিয়া জানাবে তাঁর হিজবুল্লাহ।
এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব মিসর দিয়েছে, তার ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ তৈরি করেছে আরৌরির হত্যাকাণ্ড। হামাসের নেতারা এর আগে জানিয়েছিলেন, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তাতে হামাসের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আরৌরি।
মিসর সরকারের সূত্রের বরাতে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি জানায়, যুদ্ধবিরতির ওই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে বুধবার মিসরে এসেছে ইসরায়েলের একটি প্রতিনিধিদল। ওই কর্মকর্তা বলেন, আরৌরির হত্যাকাণ্ড যুদ্ধবিরতির এ আলোচনায় বড় ধরনের বাধা হয়ে উঠতে পারে।