ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি যেসব প্রশ্নে আটকে আছে
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনী ও হামাসের মধ্যে দীর্ঘ সাত মাসের বেশি সময় ধরে লড়াই চলছে। সঙ্গে চলছে ফিলিস্তিনিদের দুঃখ–দুর্দশা। সহিংসতা বাড়ছে পশ্চিম তীরেও। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনের জনগণের রাষ্ট্র পাওয়ার সম্ভাবনা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ। কিন্তু এ পদক্ষেপ বড় ধরনের অনেক বাধার সম্মুখীন হওয়ার বাস্তবতা এড়াতে পারবে না।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ—প্রায় ১৩৯টি আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। ১০ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ১৪৩টি ফিলিস্তিনকে এই সংস্থার পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার উদ্যোগের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে। পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার এ সুযোগ শুধু কোনো রাষ্ট্রের জন্যই উন্মুক্ত।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ইউরোপীয় দেশের মধ্যে রয়েছে আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ে। এ সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ; যেমন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির ওপর চাপ তৈরি করবে।
একজন আরব কূটনীতিক বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। কথা শুনতে ইসরায়েল সরকারের অস্বীকৃতি জানানো নিয়ে ইউরোপের দেশগুলোর হতাশারই প্রতিফলন এটি। দেশগুলোর এ সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।’
তবে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা জোর দিয়ে বলেছে, এ পদক্ষেপ হামাসকে উৎসাহিত ও সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করবে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সমঝোতামূলক কোনো মিটমাটের সুযোগ আরও কমাবে।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া ফ্রান্সের কাছে নিষিদ্ধ কিছু নয়।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ—প্রায় ১৩৯টি আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। সর্বশেষ ১০ মে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ১৪৩টি ফিলিস্তিনকে এই সংস্থার পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার উদ্যোগের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে। পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার এ সুযোগ শুধু কোনো রাষ্ট্রের জন্যই উন্মুক্ত।
বর্তমানে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের’ মর্যাদা রয়েছে। ফলে ফিলিস্তিনের জন্য আসন বরাদ্দ থাকলেও সংস্থাটিতে কোনো ভোট দেওয়ার অধিকার তার নেই।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনও। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আরব লিগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)।
এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপের দেশগুলোর একটি ছোট অংশও। ১৯৮৮ সালে হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া ও বুলগেরিয়া ফিলিস্তিনের পক্ষে এ অবস্থান নেয়। একই অবস্থান সুইডেন, সাইপ্রাস ও মাল্টার।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনেক দেশ বলেছে, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানের অংশ হিসেবেই শুধু তারা ফিলিস্তিনকে কোনো রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। বিষয়টিকে প্রায়ই ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়; যেখানে নিজস্ব সীমান্তের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় পক্ষের সমর্থন থাকবে।
ফিলিস্তিনকে কখন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, তা নিয়ে ইউরোপের দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য।
আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ে বলছে, তারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করছে। তাদের যুক্তি, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—দুই পক্ষ কোনো ‘রাজনৈতিক দিগন্তকে’ নিজেদের লক্ষ্য বানাতে পারলেই শুধু বর্তমান সংকটের একটা টেকসই সমাধান অর্জন সম্ভব।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরও সমর্থন জানাতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপেরও সাড়া দিচ্ছে ওই তিন দেশ।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ইউরোপীয় দেশের মধ্যে রয়েছে আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ে। এ সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশ; যেমন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির ওপর চাপ তৈরি করবে।
অতীতে অনেক পশ্চিমা দেশের অবস্থান এমন ছিল যে চূড়ান্ত কোনো শান্তিচুক্তিতে উপনীত হওয়ার পুরস্কার হিসেবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। তবে এখন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যামেরন ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের নেতারা তাঁদের অবস্থান বদলেছেন। তাঁরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কোনো রাজনৈতিক সমাধানে গতি আনার ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতি অপ্রয়োজনীয় আগাম পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া ফ্রান্সের কাছে নিষিদ্ধ কিছু নয়।’ আর চলতি মাসের শুরুর দিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে ফ্রান্স।
ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে এ নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে তারা আগের চেয়ে বেশি সতর্কও। এমন নীতির বাস্তবে কী প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে একটা অধিকতর স্পষ্ট বার্তা পেতে চায় তারা।
এ দৃশ্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তা হলো, ফিলিস্তিনকে এখনো স্বীকৃতি না দেওয়া দেশগুলোর কবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে কবে আনুষ্ঠানিক শান্তি আলোচনা শুরু হবে, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক কবে স্বাভাবিক হবে, ইসরায়েল নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে বা ফিলিস্তিন নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হলে কী হবে ইত্যাদি।
অন্য কথায় একটা কূটনৈতিক ফলাফল অর্জনের লক্ষ্যে এক বড় মুহূর্ত হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চায় দেশগুলো। পশ্চিমা একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি একটি বড় কার্ড, যা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোকে খেলতে হবে। আমরা এ কার্ড নষ্ট করতে চাই না।’
সমস্যা হলো, বড় কিছু প্রশ্নের সমাধান না করে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে তা অনেকটা প্রতীকী হয়ে রইবে। প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনের সীমান্ত কী হবে, রাজধানী কোথায় হবে, স্বীকৃতি বাস্তবায়নে উভয় পক্ষকে প্রথমে কী করতে হবে।
এসব জটিল প্রশ্ন নিয়ে দশকের পর দশক সন্তোষজনকভাবে কোনো মতৈক্যে পৌঁছাতে বা এসবের উত্তর বের করতে পারেনি পশ্চিমা দেশগুলো। আজকের হিসাবে আগের চেয়ে হাতে গোনা আরও কয়েকটি ইউরোপের দেশ এখন মনে করছে, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
সমর্থকেরা এ পদক্ষেপে খুশি হবেন, বিরোধীরা হবেন সমালোচনামুখর। তবে ফিলিস্তিনিদের নির্মম বাস্তবতার সম্ভবত পরিবর্তন হবে না।