ঈদেও রক্ত ঝরল গাজায়: ‘এখানে কোনো উৎসব নেই’

গাজার রাফা এলাকায় ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করছেন ফিলিস্তিনিরাছবি: রয়টার্স

‘এখানে কোনো ঈদ নেই। আছে শুধু মানুষের মরদেহ। আছে আহত ব্যক্তিদের হাহাকার। আমরা কীভাবে আনন্দ করব, যখন মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে’, বলছিল ফিলিস্তিনের গাজার ১১ বছর বয়সী কিশোরী সারাহ আমের। আর ৭ বছর বয়সী ছোট্ট তালা আবু আমরের কথায়, ‘এখানে কোনো আনন্দই নেই।’

আজ বুধবার গাজায় পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। তবে গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার কারণে এ বছর ঈদের কোনো আমেজ নেই উপত্যকাটিতে। এমনকি ঈদেও সেখানে হয়েছে হামলা, ঝরেছে রক্ত। গাজা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় উপত্যকাটিতে এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৪৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১২২ জন।

আগের বছরগুলোতে গাজায় ঈদটা এমন ছিল না। এই গত বছরেই ঈদের আগের দিন রাস্তাগুলোতে থাকত মানুষের ভিড়। রাতভর কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকতেন তাঁরা। দোকানে দোকানে বিক্রি হতো হরেক পদের মিষ্টান্ন, খেজুর আর চকলেট। দোকানে সাজানো থাকত নতুন পোশাক। ঈদের সকালে দল বেঁধে ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন ফিলিস্তিনিরা। সারা দিন মেতে থাকতেন আনন্দে।

আরও পড়ুন

সে সময়ের কথা স্মরণ করছিলেন ৪৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ আল-বারবারি। ইসরায়েলের হামলা শুরুর আগে ছয় সন্তান নিয়ে থাকতেন গাজা নগরীতে। হামলার মুখে ছয় মাস আগে রাফায় পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি। বারবারি বলেন, ‘আমরা সারা রাত জেগে থাকতাম। মিষ্টান্ন কিনতাম। সন্তানদের পোশাক কিনে দিতাম। এ বছর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়াই তাঁবুতে থাকতে হচ্ছে।’

মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে চাঁদরাতে হামলা চালায় ইসরায়েল বাহিনী। এতে নিহত এক শিশুর মরদেহ কোলে এক স্বজন
ছবি: এএফপি।

গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতা শুধু ফিলিস্তিনিদের প্রাণই কেড়ে নেয়নি, সেখানে দেখা দিয়েছে খাবার ও পানির তীব্র সংকট। উপত্যকাটিতে প্রয়োজনীয় ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এতে চরম দুর্দশায় রয়েছেন সেখানকার ২৪ লাখ বাসিন্দা। তাঁদের বেশির ভাগই এখন আশ্রয় নিয়েছেন একেবারে দক্ষিণে মিসর সীমান্তের রাফাহ এলাকায়।

এত দুর্দশার মধ্যেও গাজার বাসিন্দাদের অনেকে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। রাফায় আশ্রয় নেওয়া হারুন আল-মেদাল্লাল বলছিলেন, গাজার যেসব শিশু মা-বাবা ও বাড়িঘর হারিয়েছে, তাদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে বিস্কুট তৈরি করছেন সেখানকার নারীরা। হারুন বলেন, ‘দুঃখ-কষ্ট, ধ্বংস, বাস্তুচ্যুত হওয়া ও নির্বিচার গোলা হামলার মধ্যেও আমরা জীবনকে ভালোবাসি।’

আরও পড়ুন

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। এতে নিহত হন ১ হাজার ১৩৯ জন। এর পরপরই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। দেশটির ভাষ্য, হামাসকে নির্মূল করতেই তাদের এ অভিযান। তবে বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। ইসরায়েলের হামলায় নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশ বেসামরিক মানুষ। আর মোট নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু।

রাফায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত স্বজনের কবর ঈদের দিন জিয়ারত করতে যান দুই ফিলিস্তিনি নারী
ছবি: রয়টার্স

সে হিসাবে ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে বড় শিকারটা হয়েছে গাজার শিশুরা। গাজার খান ইউনিস এলাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি এমনই এক শিশু খলিল আবু হাসনাইন। গত বছর গাজা নগরীর শেখ রেদওয়ান এলাকায় নিজ বাড়িতে ঈদ করেছিল সে। হাসনাইন বলল, ‘আমরা কেক ও বিস্কুট বানাতাম, নতুন পোশাক কিনতাম আর ঈদের জন্য অপেক্ষা করতাম। এবার ঈদে সেসব কিছুই নেই।’

ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত গাজায় ঈদের দিন শিশুদের খেলাধুলা
ছবি: এএফপি

এবারের ঈদে অনেক ফিলিস্তিনি প্রিয়জন হারানোর শোকে কাতর। আজ সকালে ছেলে ফুয়াদ আবু খামাশের কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন তাঁর মা। ফুয়াদ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেড ক্রিসেন্টের একজন সদস্য ছিলেন। মানবিক সহায়তার কাজ করার সময়েই ইসরায়েলের হামলায় প্রাণ হারান তিনি। উম আহমদ নামের আরেক নারী বললেন, ‘আজ ঘুম থেকে ওঠার পর আমার স্বামীর কথা খুব মনে পড়ছিল। তিনি এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।’

আরও পড়ুন