মধ্যপ্রাচ্যে সাবমেরিন পাঠিয়ে যে বার্তা দিতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলে ইরানের হামলার আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে ইসরায়েলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে উত্তেজনা বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দ্রুত রণতরি পাঠানোর পাশাপাশি নতুন করে সাবমেরিন পাঠানো হচ্ছে। ইরানের হুমকির মুখে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে ফোনালাপের পর এ পদক্ষেপ নেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন।
পেন্টাগন জানিয়েছে, অস্টিন ইউএসএস জর্জিয়া নামে সাবমেরিনটিকে মধ্যপ্রাচ্য যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইউএসএস জর্জিয়া মূলত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত একটি পারমাণবিক সাবমেরিন। এটি ইতালির কাছে মহড়া শেষে ভূমধ্যসাগরে কাজ করছিল। এ ছাড়া অস্টিনের পক্ষ থেকে রণতরি ইউএসএস আব্রাহাম লিংকন ও এফ-৩৫সি যুদ্ধবিমান মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই অঞ্চলে থাকা আরেকটি রণতরির স্থানে ইউএসএস আব্রাহাম লিংকন মোতায়েন রাখা হবে। এ রণতরিকে দ্রুত গন্তব্যে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সাধারণত মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিনগুলোর গতিবিধি খুব কমই প্রকাশ্যে জানানো হয়। এ ধরনের সাবমেরিনের কাজ গোপনীয়। তাই সাবমেরিনটিকে মোতায়েনের প্রকাশ্য ঘোষণাকে ইরান ও তার মদদপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর (প্রক্সি) জন্য স্পষ্ট বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিবিসি বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েল ও মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অস্টিন বলেছেন, মিত্রকে রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত তাঁরা।
ইরানের রাজধানী তেহরানে গত ৩১ জুলাই দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়ে নিহত হন হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়া। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে তেহরান। ইরান এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে এ হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র।
ইরান ছাড়াও ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে ইরান–সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। হানিয়াকে হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে বৈরুতে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা ফুয়াদ শুকরকে হত্যা করে ইসরায়েল। ইসরায়েলের এ হামলার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতেই ইসরায়েলকে রক্ষা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
কাতারের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহরান কামরাভা বলেন, ইরান ও হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে সাবমেরিন পাঠাচ্ছে। তবে তিনি বলেন, এর অর্থ হচ্ছে, গোপনে এমন কিছু ইঙ্গিত হতে পারে যে ইরান আসলে কিছু করতে চলেছে।
এরই মধ্যে ইসরায়েলে হামলা শুরু করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী গত রোববার সন্ধ্যায় জানায়, লেবানন থেকে প্রায় ৩০টি রকেট ছোড়া হয়েছিল। অবশ্য সেগুলোর কিছু খোলা জায়গায় পড়েছিল এবং কেউ হতাহত হননি। হিজবুল্লাহ জানায়, ফিলিস্তিনিদের সমর্থন ও লেবাননে ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ হিসেবে এ রকেট হামলা করা হয়।
যুদ্ধবিরতির চেষ্টা
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে রক্ষায় সামরিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি গাজা নিয়ে যুদ্ধবিরতির কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন প্রশাসন মনে করছে, যুদ্ধবিরতির মাধ্যামে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমাতে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি দেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানানো হয়। এরপর শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের নেতারা ১৫ আগস্টের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির চুক্তি চূড়ান্ত করতে ইসরায়েল ও হামাসকে আবার আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানায়।
তবে রোববার রাতে হামাসের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। হামাস জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে তিন ধাপের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটি ইসরায়েলকে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। এ ছাড়া নতুন কোনো যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে তারা যাবে না। হামাস বলেছে, তারা আলোচনার পুরো প্রক্রিয়ায় নমনীয়তা দেখিয়েছে। তবে ইসরায়েলি পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এর আগে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ার জন্য হামাসকে দায়ী করা হয়েছিল। তবে ইসরায়েলি গণমাধ্যম বলছে, মার্কিন কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ার জন্য আংশিক দায়ী করতে শুরু করেছে। নেতানিয়াহু ইসরায়েলে ডানপন্থী জোটের নেতাদের সন্তুষ্ট করতে এ চুক্তির বিরোধিতা করছেন বলে অভিযোগ করছে বাইডেন প্রশাসন। গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউস প্রকাশ্যে ইসরায়েলের ক্ষমতায় থাকা জোট নেতাদের সমালোচনা করে।
ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি নিয়ে মার্কিন চাপ প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এটা হবে হামাসের কাছে আত্মসমর্পণের সমান। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কারবি বলেন, মিথ্যা দাবি করছেন স্মোটরিচ।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির পক্ষ থেকেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেছেন, ‘আমরা সম্মত হয়েছি যে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আর দেরি করা যাবে না। আমরা উত্তেজনা কমাতে সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। উত্তেজনা কমিয়ে স্থিতিশীলতার পথে হাঁটতে কোনো কোনো ছাড় দিচ্ছি না।’