শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা নেতানিয়াহুর পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে কি ইঙ্গিত দিচ্ছে

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুফাইল ছবি: রয়টার্স

লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান দ্বিতীয় সপ্তাহ পার করতে চলল। ইতিমধ্যে, এই অঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধ দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বৈরুতে বিমান হামলা এবং গতকাল শুক্রবার দক্ষিণ লেবাননে দ্বিতীয় দিনের মতো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর ইসরায়েলের গোলা নিক্ষেপের ঘটনায় জোরালো হয়েছে যুদ্ধবিরতির আহ্বান।

এরই মধ্যে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার উত্তরে জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে শুরু হয়েছে ইসরায়েলের নতুন আক্রমণ। যদিও গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ইসরায়েলের প্রতি অব্যাহতভাবে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ইরানের গত সপ্তাহের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দিতে ইসরায়েলের প্রস্তুতি নেওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশটির মিত্ররাও তাকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

এত কিছুর পরও ইসরায়েল তার নিজের পথে এগিয়ে চলেছে। উপেক্ষা করছে ওইসব চাপ ও আহ্বান। দেশটির এই একগুঁয়েমির পেছনে আছে মূলত তিনটি বিষয়—৭ অক্টোবর, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও যুক্তরাষ্ট্র।

গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা, ধ্বংসযজ্ঞ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফে যুদ্ধবিরতির আহ্বান—এত কিছুর পরও ইসরায়েল তার নিজের পথে এগিয়ে চলেছে। উপেক্ষা করছে ওইসব চাপ ও আহ্বান। দেশটির এমন একগুঁয়েমির পেছনে আছে মূলত তিনটি বিষয়—৭ অক্টোবর, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও যুক্তরাষ্ট্র।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। একদিন নৈশ ফ্লাইটে ইরানের জেনারেল কাসেম সোলাইমানি সিরিয়ার দামেস্ক থেকে ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরে এসে অবতরণ করেন। তিনি ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বিশেষ শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন। এ ফোর্স বিদেশে ইরানের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

কুদস ফোর্সের প্রধান শত্রু ইসরায়েল। লক্ষ্য অর্জনে এ বাহিনী ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন ও অন্যান্য স্থানে তার প্রক্সি বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া ও অর্থায়নে কাজ করছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পর কাসেম সোলাইমানিকে দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে মনে করা হতো।

সোলাইমানির গাড়িবহর বিমানবন্দর ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্রোন থেকে চালানো ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।

এ হামলায় ইসরায়েল গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। ড্রোনটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার ওই নির্দেশ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নন, দিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে এক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, কাসেম সোলাইমানির ওপর হামলার ঘটনায় তিনি ইসরায়েলের কাছ থেকে আরও সক্রিয় ভূমিকা আশা করেছিলেন।

সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনার প্রশংসা করেছিলেন নেতানিয়াহু। ধারণা করা হয়, এ হত্যায় ইসরায়েল সরাসরি অংশ নিলে দেশটির বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ শুরুর আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। এ আক্রমণ হয় ইরানের তরফে, নয় লেবানন ও ফিলিস্তিনে থাকা তার প্রক্সি বাহিনীর পক্ষ থেকে হতো। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ এড়াতে ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য, বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে অন্যান্য দেশের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় দুইপক্ষ ছায়াযুদ্ধকে নিজেদের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রাখতে সচেতন।

মাত্র চার বছর পরই এ বছরের এপ্রিলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বয়ং সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কূটনৈতিক ভবনে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে বোমা হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। হামলায় অন্যদের সঙ্গে ইরানের দুই জেনারেল নিহত হন।

এর পর গত জুলাইয়ে বৈরুতে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর শীর্ষস্থানীয় সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শোকরকে বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করার বিষয়ে অনুমোদন দেন নেতানিয়াহু।  

এর আগে গত বছরের ৭ অক্টোবর মঞ্চায়ন হয় আরেক দৃশ্যপটের। ওই দিন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের ভেতর নজিরবিহীন হামলা চালায়। ইসরায়েলের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী এ হামলা ছিল দেশটির রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতারই প্রতিফলন।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি হামলায় গাজায় বেঘোরে মারা পড়ছেন মানুষ। বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ও গাজার বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় দুর্দশায় রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার শিকার মার্কিন প্রশাসন। ব্যাপক সমালোচনা ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অনেক দিন ধরেই গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।  

গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে চলতি গ্রীষ্মে হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাত বাড়ানোকে বেছে নিয়েছে ইসরায়েল। এ ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদনের অপেক্ষা করেনি দেশটি।

ইসরায়েলের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে চলা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর ২০ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ একেবারে এড়ানো না গেলেও কোনো না কোনোভাবে তিনি তা ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। তিনি জানেন, বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এ বছরে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যা তাঁকে (নেতানিয়াহু) লক্ষ্যচ্যুত করতে পারে।

এখন কী করবে ইসরায়েল

ইসরায়েল এখন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এটি শুধু এ জন্য নয় যে দেশটি মনে করে, তারা আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করতে সক্ষম। বরং এর পেছনে রয়েছে ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে তার বাইরের হুমকি সহ্য করার সক্ষমতার বিষয়টিও।

যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ইসরায়েল তেহরানে অতিথি হিসেবে থাকাকালেই হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করেছে; হত্যা করেছে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ সংগঠনটির বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে। আরও হত্যা করেছে সিরিয়ায় কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থানকারী ইরানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এসব ঘটনার জবাবে ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে ছুড়েছে ৯ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন। তেল আবিবে হামলা চালিয়েছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের। বসে নেই ইরান–সমর্থিত ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও। তাঁরাও ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে চালিয়েছ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। যদিও এসব হামলার বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় প্রতিরোধ করেছে ইসরায়েল।

আর ইরান গত ৬ মাসে ইসরায়েলে শুধু একবার নয় দুবার সরাসরি হামলা চালিয়েছে। হামলায় তারা ব্যবহার করেছে ৫ শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র। অন্যদিকে, বর্তমানে গাজার পাশাপাশি লেবাননে আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরায়েল।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন