ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বের দ্বার এখনো খোলা সৌদি আরবের, তবে শর্ত আছে
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ অগ্রগতি হয়েছিল ইসরায়েলের। চারটি দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর সৌদি আরবের সঙ্গেও ইহুদি রাষ্ট্রটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা নিয়ে আলোচনা এগিয়েছিল। এমন অবস্থার মধ্যে গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক কীভাবে প্রতিষ্ঠা সম্ভব, তা নিয়ে লিখেছেন সিএনএনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাংবাদিক নাদিন ইব্রাহিম।
ফিলিস্তিনের গাজায় গত ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া সংঘাতের কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বেশ কাছাকাছি ছিল সৌদি আরব। এখন সংঘাতের তিন মাসে পেরিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন ২৪ হাজারের বেশি মানুষ। এ নিয়ে উত্তাল আরব বিশ্ব। এরপরও ইসরায়েলের স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে রিয়াদ।
গাজায় সংঘাত শুরুর পর কয়েকবার মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। সর্বশেষ তিনি সৌদি আরব, ইসরায়েলসহ এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। সৌদি আরব থেকে ইসরায়েলে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের ব্লিঙ্কেন বলেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা চলতে থাকবে। আর এ লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এ অঞ্চলে স্পষ্ট আগ্রহও রয়েছে।
‘সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তিই হলো যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কারও জন্য একমাত্র উপায়, যেখানে ইসরায়েলকে ছাড় দিতে রাজি করানো সম্ভব হবে।’
গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার পরও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে সৌদি আরবও। গত সপ্তাহে বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালিদ বিন বান্দার। সেখানে তিনি বলেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহটা অবশ্যই আছে। এমনকি ১৯৮২ সাল থেকেই এই আগ্রহ রয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, গাজা সংঘাতের আগে সময়ের তুলনায় এখন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে সৌদি আরবের দাবি-দাওয়া বেশি থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কাছ থেকে নিজেদের আরও বেশি দাবি ছাড় করিয়ে নিতে পারে রিয়াদ।
এ নিয়ে সৌদি আরবের লেখক ও বিশ্লেষক আলী শিহাবি সিএনএনকে বলেছেন, দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তি তৈরি করতে ইসরায়েলকে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার শর্ত দিতে পারে সৌদি আরব। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ইসরায়েলকে গাজা অবরোধ প্রত্যাহারের শর্ত দেওয়া হতে পারে। একই সঙ্গে গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে (পিএ) পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি তোলা হতে পারে। দেওয়া হতে পারে পশ্চিম তীর থেকে অবৈধ ইহুদি বসতি সরিয়ে নেওয়ার শর্তও।
ইসরায়েলের দখল করা পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চান ফিলিস্তিনিরা।
এর আগে যেসব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে, ইসরায়েল তাদের মিথ্যা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল উল্লেখ করে আলী শিহাবি বলেছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে এমনটি করলে চলবে না। তাঁর ভাষ্য, ইসরায়েল যদি মধ্যপ্রাচ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে আরও এগোতে চায়, সে জন্য গাজায় সংঘাত বন্ধ করতে হবে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একটি বাস্তবসম্মত পথ তৈরি করতে হবে।
ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চান ফিলিস্তিনিরা। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বেশির ভাগ মুসলিম ও আরব দেশ। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির অন্যান্য কর্মকর্তা স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নাকচ করে আসছেন। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেছেন, ইসরায়েল সরকার দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান চায় না।
২০২০ সালে বেশ কিছু চুক্তির আওতায় ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মুসলিম বিশ্বের চার দেশ—সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। ওই চুক্তি আব্রাহাম অ্যাকর্ডস নামে পরিচিত। চুক্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের যে দাবি, তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন থেকেই সৌদি আরবকে এই চুক্তির আওতায় আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের ধারণা, সৌদি আরবকে যেহেতু মুসলিম বিশ্বের নেতা মনে করা হয়, তাই দেশটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলে একই পথে হাঁটতে পারে অন্যান্য মুসলিম দেশ।
ইসরায়েলের বর্তমান যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ সতর্ক রিয়াদ।
দুই দশক ধরে রিয়াদের অবস্থান ছিল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। তবে ৭ অক্টোবরের হামলার আগে গত কয়েক বছরে ইসরায়েলের বিষয়ে আলোচনায় সৌদি কর্তৃপক্ষ থেকে বিষয়টি তোলা হয়নি। গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে তাঁর দেশের শর্তগুলো কী কী? জবাবে যুবরাজ বলেছিলেন, দুই দেশের মধ্যে চুক্তি ফিলিস্তিনিদের জীবনকে সহজ করে তুলবে। তবে সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেননি তিনি।
ওই সময়ে সৌদি আরবের সরকারি বক্তব্য ছিল, দেশটির নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চয়তা আরও জোরদার করার বিষয়টি ঘিরে। উঠছিল সৌদি আরবের বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্পে মার্কিন সহায়তার বিষয়গুলোও। তবে ৭ অক্টোবর হামলার পর চিত্রপট পাল্টে যায়। এর পরপরই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনা স্থগিত করে রিয়াদ।
গত ১৪ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি জরিপ চালিয়েছিল ইসরায়েলপন্থী মার্কিন গবেষণা সংস্থা ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নেয়ার ইস্ট পলিসি। দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজার সৌদি নাগরিকের ৯৬ শতাংশই বিশ্বাস করেন, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সব ধরনের চুক্তি বাতিল করা উচিত আরব দেশগুলোর।
গাজা সংঘাত শুরুর পর দেখা যাচ্ছে, সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনায় আবার ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক ফিরাস মাকসাদ বলেন, গাজা সংঘাতের কারণে সৌদি আরবের জনমতে যে প্রভাব পড়েছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে ইসরায়েলের কাছ থেকে আরও অর্থপূর্ণ সুবিধা নিতে হবে রিয়াদকে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় উপত্যকাটিতে ২৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস যোদ্ধারা ঢুকে হামলা চালান। এর পর থেকেই গাজায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। সংগঠনটির হামলায় সেদিন ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার। এ ছাড়া ইসরায়েল থেকে ২৪০ জনের বেশি ব্যক্তিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা।
বিবিসিকে সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালিদ বলেন, ‘৭ অক্টোবরের পরও আমরা সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় বিশ্বাস রাখছি। সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে, তা করা হবে না।’
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যেকোনো চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ ‘মূল বিষয়’ হবে উল্লেখ করে প্রিন্স খালিদ বলেন, এটি সৌদি-ইসরায়েল শান্তি পরিকল্পনা নয়, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল শান্তি পরিকল্পনা।
সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করাটা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রধান অগ্রাধিকারগুলোর অন্যতম। দুই দেশের মধ্যে এমন কোনো চুক্তিতে মধ্যস্থতা করতে পারাটা চলতি বছরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাইডেন সরকারের জন্য বড় একটি সফলতা হবে।
তবে ইসরায়েলের বর্তমান যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সঙ্গে কোনো চুক্তিতে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ সতর্ক রিয়াদ। এই মন্ত্রিসভায় ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ডানপন্থী সদস্যরা রয়েছেন। এমনকি ইসরায়েলের বর্তমান মন্ত্রীদের একজন তো মনে করেন, গাজা সংঘাতের জন্য আরব বিশ্ব দায়ী।
ইসরায়েলের বর্তমান অবস্থানকে ‘উগ্র’ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রদূত প্রিন্স খালেদ বিবিসিকে বলেন, ‘দখলীকৃত ভূমি সমস্যা নয়। বসতি স্থাপনকারীদের দখলও সমস্যা নয়। সমস্যা হলো বসতি স্থাপনকারীরা এখন ইসরায়েলি সরকার দখল করে ফেলেছে। এ মাধ্যমে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, উগ্রপন্থী বসতি স্থাপনকারীরা এবং তাদের মানসিকতা একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়েছে।’
সৌদি বিশ্লেষক আলী শিহাবি বলেন, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তিই হলো যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কারও জন্য একমাত্র উপায়, যেখানে ইসরায়েলকে ছাড় দিতে রাজি করানো সম্ভব হবে। বিষয়টি রিয়াদের মাথায় আছে। তাই এই চুক্তির মাধ্যমে গাজা সংঘাতের চূড়ান্ত সমাধানের চেষ্টা করতে চায় তারা।