তালাক দেওয়ার অধিকার ফিরে পেতে দেশছাড়া এক আফগান ‘বালিকাবধূ’
আফগানিস্তানের প্রতিবেশী একটি দেশে দুই ব্যস্ত সড়কের মধ্যে গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন একজন তরুণী। নিজের কাছে সযত্নে গুছিয়ে রেখেছেন একগাদা নথিপত্র।
বিবি নাজদানার কাছে তাঁর জগতে এই নথিপত্রের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নয়। এগুলো আদালত থেকে তাঁকে বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দেওয়ার নথি। দুই বছর আইনি লড়াই করে তিনি এ অধিকার জিতেছিলেন। মুক্ত হয়েছিলেন একজন বালিকাবধূর জীবন থেকে।
কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর নাজদানার পক্ষে যাওয়া আদালতের ওই নির্দেশ বাতিল করা হয়। তিন বছর আগে তালেবান পুনরায় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসে দেশটির আগের সরকারের আমলে হওয়া হাজার হাজার মামলার রায় বাতিল করে।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পরপরই নাজদানার বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার রায় বাতিলের আবেদন করেন তাঁর সাবেক স্বামী হেকমাতুল্লাহ। কঠিন লড়াই করে এ অধিকার জিতেছিলেন এ তরুণী।
আমি সাহায্যের আশায় অনেকের কাছে গেছি, এমনকি জাতিসংঘের কাছেও। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি। সহায়তা কোথায়? একজন নারী হিসেবে আমার কি কোনো স্বাধীনতাই প্রাপ্য নয়।
নাজদানার বাবা যখন হেকমাতুল্লাহর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র সাত বছর। পারিবারিক ‘শত্রুতার’ অবসান ঘটিয়ে ‘বন্ধু’ হতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নাজদানার বয়স ১৫ বছর হলে হেকমাতুল্লাহ স্ত্রীর দাবি নিয়ে তাঁদের বাড়িতে হাজির হন।
ওই সময় কিশোরী নাজদানা এটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি আদালতে গিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত আশরাফ গনি সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ছিল। নাজদানা বারবার আদালতকে বলেন, তিনি কৃষক হেকমাতুল্লাহকে বিয়ে করতে পারবেন না। দুই বছর আইনি লড়াই চালান তিনি। শেষ পর্যন্ত আদালত তাঁর পক্ষে রায় দেন।
নাজদানা বলেন, ‘আদালত আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “আপনি এখন বিচ্ছিন্ন ও মুক্ত। নিজের ইচ্ছেমতো যে কাউকে বিয়ে করতে পারেন।”’
কিন্তু ২০২১ সালে তালেবান আবার ক্ষমতায় আসার পর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন হেকমাতুল্লাহ।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ৩ লাখ ৫৫ হাজার মামলার বিচার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে। সেগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশই জমি নিয়ে বিরোধসংক্রান্ত। ৩০ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদসহ পারিবারিক নানা বিরোধের।
তালেবান প্রশাসন থেকে নাজদানাকে বলা হয়, তিনি নিজে আদালতে গিয়ে এ মামলা লড়তে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে নাজদানা বলেন, ‘আদালতে, তালেবান আমাকে বলেছিল, আমার আর আদালতে আসা উচিত হবে না। কারণ, এটা শরিয়াহ আইনবিরোধী। আমার পরিবর্তে মামলা লড়তে তারা আমার ভাইকে আদালতে পাঠাতে বলে।’
নাজদানার ভাইয়ের নাম শামস, বয়স ২৮ বছর। শামস বলেন, ‘তারা (তালেবান) আমাকে বলেছিল, যদি তাদের কথা না শুনি তবে তারা জোর করে আমার বোনকে তাঁর (সাবেক স্বামী হেকমাতুল্লাহ) হাতে তুলে দেবে।’
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর কৃষক হেকমাতুল্লাহ তাদের সদস্য হন, মামলাও জিতে যান।
আফগানিস্তানের উরুজগান প্রদেশের বাসিন্দা ওই দুই ভাই–বোন বুঝতে পারেন, কেউ তাঁদের কথা শুনবেন না। তাঁদের সামনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর পথ খোলা নেই।
তিন বছর আগে তালেবান আবারও আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তারা অতীতের দুর্নীতির অবসান ঘটানো ও শরিয়াহ আইনের অধীনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা করে। তখন থেকে তালেবান ৩ লাখ ৫৫ হাজার মামলার কার্যক্রম আবার শুরু করেছে। সেগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশই জমি নিয়ে বিরোধসংক্রান্ত। ৩০ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদসহ পারিবারিক নানা বিরোধের।
‘তারা (তালেবান) আমাকে বলেছিল, যদি তাদের কথা না শুনি তবে তারা জোর করে আমার বোনকে তাঁর (সাবেক স্বামী হেকমাতুল্লাহ) হাতে তুলে দেবে।’
বিবিসির প্রতিনিধিরা কাবুলে আফগানিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের নথিপত্র দেখার বিশেষ অনুমতি পেয়েছিল। সেখানে নথিপত্র ঘেঁটে তাঁরা নাজদানার মামলার বিষয়টি সামনে আনেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের গণমাধ্যমবিষয়ক কর্মকর্তা আবদুলওয়াহিদ হাক্কানি মামলার রায় হেকমাতুল্লাহর পক্ষে গেছে বলে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘আগের দুর্নীতিবাজ প্রশাসন হেকমাতুল্লাহ ও নাজদানার বিয়ে বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা শরিয়াহ ও বিয়ের নিয়মকানুনের পরিপন্থী ছিল।’ যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, বিচারের সময় (আগেরবার) হেকমাতুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন না। ফলে বিচার বৈধ হয়নি।
এমনটা নয় যে তালেবান শুধু মীমাংসিত মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম আবার শুরু করেছে; বরং তালেবান সব বিচারককেও সরিয়ে দিচ্ছে। পুরুষ ও নারী উভয় বিচারকই। তাঁদের জায়গায় যাঁদের আনা হচ্ছে, তাঁরা মূলত তালেবানের কট্টর মতাদর্শের সমর্থক। অযোগ্য ঘোষণা করে নারীদের বিচারব্যবস্থা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রায় এক বছর আগে আফগানিস্তান থেকে প্রতিবেশী একটি দেশে পালিয়ে গেছেন নাজদানা ও তাঁর ভাই। নাজদানার বয়স এখন ২০ বছর। বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার পাওয়া নথিপত্রগুলো খুবই যত্ন করে রেখেছেন তিনি। আশায় আছেন, কেউ হয়তো তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসবেন।
নাজদানা বলেন, ‘আমি সাহায্যের আশায় অনেকের কাছে গেছি, এমনকি জাতিসংঘের কাছেও। কিন্তু কেউ আমার কথা শোনেনি। সহায়তা কোথায়? একজন নারী হিসেবে আমার কি কোনো স্বাধীনতাই প্রাপ্য নয়।’