ফিরে দেখা
ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তির কারণেই কি খুন হয়েছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত
১৯৭৭ সালে প্রথম কোনো আরব নেতা হিসেবে ইসরায়েল সফর করেছিলেন তৎকালীন মিসরীয় প্রসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। এক বছর পর ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন এ নেতা। এর জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ১৯৮১ সালের অক্টোবর মাসে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সাদাত। মিসরের সাবেক এ প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আজকের এ ফিরে দেখা।
১৯৮১ সালের অক্টোবর। দিনটি ছিল মাসের ৬ তারিখ। মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এক সামরিক কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করছিলেন। ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের ১৯৭৩ সালের যুদ্ধকে স্মরণ করে ওই কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়েছিল। কয়েক হাজার সেনা এতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কেউ কুচকাওয়াজ দেখছিলেন, আবার কেউ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তবে হাজার হাজার সেনার মধ্যে অস্ত্র ছিল গুটিকয়েকের হাতে। সতর্কতা হিসেবে কুচকাওয়াজে থাকা কয়েকজন সেনার হাতে অস্ত্র ছিল। তবে সেগুলোতে আসলে গুলি ছিল না। লোক দেখানোর জন্য অস্ত্রগুলো বহন করা হচ্ছিল। তবে খুনিরা তাঁদের একে-৪৭ রাইফেলে ঠিকই গুলি ভরে ওত পেতে ছিলেন। সুযোগ বুঝে কুচকাওয়াজের একপর্যায়ে আনোয়ার সাদাতের ওপর গুলি চালান তাঁরা। নিহত হন মিসরের প্রেসিডেন্ট।
যেভাবে উত্থান
১৯১৮ সালে মিসরের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় আনোয়ার সাদাতের। তাঁর ভাই-বোনের সংখ্যা ১৩। ১৯৩৮ সালে কায়রো মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক করেন সাদাত। এর পর মিসরের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কর্মজীবনের শুরুতে তাঁকে সুদানে নিযুক্ত করা হয়। সেখানে জামাল আবদেল নাসের তাঁর সহকর্মী ছিলেন। এ নাসের পরবর্তীতে মিসরের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
সাদাত এবং নাসের আরও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। তাঁরা এর নাম দেন ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্ট। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মিসরকে মুক্ত করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি ব্রিটিশ বাহিনীকে উৎখাত করার জন্য জার্মানির সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করেন। ১৯৪২ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই বছর পর ছাড়া পান সাদাত। তবে আবার ১৯৪৬ সালে আটক হন। ব্রিটিশপন্থী এক মন্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তখন। ১৯৪৮ সালে এ অভিযোগ থেকে খালাস পান সাদাত।
কারামুক্ত হওয়ার পর কিছুদিন সাধারণ জীবনযাপন করেন সাদাত। এর পর আবারও ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন। তত দিনে এর সদস্য সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে গেছে। ১৯৫২ সালে রাজা প্রথম ফারুককে উৎখাতে পরিচালিত অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন সাদাত।
এর পর মিসরের নতুন সরকারের প্রেসিডেন্ট হন নাসের। আর সাদাত সরকারের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৭ সালে মিসর-ইসরায়েলের মধ্যে ছয় দিনের যুদ্ধ চলাকালে সাদাত সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সহযোগিতা চান। তবে তাতে তিনি সাড়া পাননি। মিসরের তখন ব্যাপক পরাজয় হয়। তাদের বিমানবাহিনীর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং আক্রমণের সক্ষমতার একটা বড় অংশই নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি তাদের সিনাই উপত্যকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও হারাতে হয়েছিল।
১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের মারা যান। তখন তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাদাত। নাসেরের মৃত্যুর পর সাদাত তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ইহুদিদের ‘ইয়ম কিপুর’-এর ছুটির দিনে মিসর ও সিরিয়ার সেনারা আকস্মিকভাবে হামলা চালায়। সিনাই উপত্যকায় মিসরীয় সেনাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সামরিক সাফল্য অর্জন করতে দেখে ইসরায়েলি হতবাক হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি বাহিনীকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার পর যুদ্ধের সে স্রোত আরবদের প্রতিকূলে যেতে শুরু করে।
ওই যুদ্ধের পর মিসর দুর্বল অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ বিবাদের ঘটনা সামলাতে হিমশিম খেতে থাকে। সাদাত তখন সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর মনে হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মিসরের জন্য ভালো কিছু হতে পারে।
ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা
আনোয়ার সাদাত ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলে যান। সেটাই ছিল কোনো আরব নেতার প্রথম ইসরায়েল সফর। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের কয়েক বছরের মাথায় তাঁর এ সফরকে আরব নেতারা ভালোভাবে নেননি। বিরোধিতা উপেক্ষা করেই জেরুজালেম সফর করেন সাদাত।
পরের বছর ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডের ক্যাম্প ডেভিড সফর করেন সাদাত। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ও তাঁর দলবলের সঙ্গে সাদাতের ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
তবে আলোচনা চলার সময় বেগিন সিনাই উপত্যকা থেকে ইহুতি বসতি সরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ক্ষিপ্ত হন সাদাত। তিনি আলোচনা থেকে সরে আসার হুমকি দেন। এমন অবস্থায় জিমি কার্টার তাঁকে থামান। কার্টার তাঁকে বলেন, ‘আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আলোচনা চালিয়ে যেতে চাইব, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি ক্যাম্প ডেভিডে থাকবেন। আমি এটাকে আমাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এবং মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর গুরুতর আঘাত বলে মনে করব।’
অবশেষে আলোচনার মধ্য দিয়ে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে সম্মত হয় দুই পক্ষ। তবে এর জন্য ফিলিস্তিনিদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়, ইসরায়েল মিসরকে সিনাই উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেবে। আর বিনিময়ে মিসর ইহুদি রাষ্ট্রটিকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেবে ও পুরোপুরি কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে। এ ছাড়া সুয়েজ খাল দিয়ে মুক্তভাবে ইসরায়েলি জাহাজ চলাচলের সুযোগ দেবে মিসর।
ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে চলা যুদ্ধাবস্থার অবসান হয়।
ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনা প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৮ সালে আনোয়ার সাদাতকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনও শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বিতর্ক
মিসরের অভ্যন্তরে অনেকে ইসরায়েলের সঙ্গে এ শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন। এ ছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ, ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদের দেড় হাজার সদস্যকে আটক, মুক্তমতের ওপর দমনপীড়ন, দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে কেন্দ্র করে মিসরীয়দের মধ্যে সাদাতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হতে থাকে।
১৯৮১ সালে ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদের সদস্যদের হাতে হত্যার শিকার হন সাদাত।
কেন হত্যার শিকার হয়েছিলেন
২০২১ সালের ৫ অক্টোবর আরব নিউজে লেবাননের অর্থনীতিবিদ এবং নিউইয়র্কে লেবানিজ আমেরিকান ইউনিভার্সিটির নির্বাহী পরিচালক নাদিম শেহাদির একটি কলাম প্রকাশ হয়। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘১৯৭৭ সালের ১৯ নভেম্বর জেরুজালেম ঐতিহাসিক সফরের মধ্য দিয়ে আনোয়ার সাদাত বিশ্বকে এমনকি নিজের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাকে চমকে দিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি সাহসী ও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, যার হাত ধরে এক বছর পর ক্যাম্প ডেভিডে মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এর জন্য তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে।’
এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কয়েকটি কারণ আছে বলে উল্লেখ করেন নাদিম শেহাদি। তবে তিনি মনে করেন, এগুলোর মধ্যে দুটি কারণ বেশ প্রাসঙ্গিক। এর একটি হলো-সাদাত তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের নীতিগুলো থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। তিনি নীতিমালায় বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস করেছিলেন। এর নাম দিয়েছিলেন ইনফিতাহ বা ‘দেশকে উন্মুক্ত করা’। আনোয়ার সাদাত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী থেকে দূরে সরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঘেঁষছিলেন। আর এতেই জামাল নাসেরপন্থীরা আনোয়ার সাদাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
আরেকটি কারণ ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সাদাতের সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, নির্বাসিতদের দেশে ফেরার সুযোগ দিয়েছিলেন, তাদের প্রকাশনার এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য সীমিত আকারে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
নাদিম শেহাদি মনে করেন, দেশকে উদারীকরণ এবং দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে হয়তো সাদাত এসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু নাসেরপন্থীদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের বিপদ নিজে ডেকেছিলেন। কারণ, এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তারা অনুপ্রবেশ করে এবং ঘাতকেরা সেই কুচকাওয়াজের অংশ হওয়ার সুযোগ পায়।
মিসরে ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ ছিল অনেক বেশি চরমপন্থী একটি সংগঠন। তাদের লক্ষ্য ছিল মিসরের প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং মিসরকে ইসলামি আমিরাতে পরিণত করা। আনোয়ার সাদাতকে হত্যার সময় সংগঠনটির নেতা এবং প্রধান কৌশল প্রণয়নকারী ছিলেন আবুদ আল জুমার। তাঁকে সাদাত হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।
আয়মান আল জাওয়াহিরি ছিলেন আবুদ আল জুমার সহযোগী। আল জুমার কারাগারে যাওয়ার পর জাওয়াহিরি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। পরে এ জাওয়াহিরিই আল কায়েদা নেতা হয়েছিলেন। প্রায় ৩০ বছর কারাগারে থাকার পর মুক্তি পান জুমার। ২০১১ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুমার দাবি করেছিলেন, তিনি অস্ত্র দিয়েছিলেন, সাদাতকে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন, তবে হত্যার নির্দেশ তিনি দেননি।
এনবিসিকে জুমার আরও বলেছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিই সাদাতকে হত্যার একমাত্র কারণ নয়। তাঁকে শরিয়া আইনবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল তারা। এ ছাড়া স্বৈরশাসনের ধারণা সামনে এনে সাদাত জনগণের অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন বলেও মনে করত ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ।
সূত্র: আল জাজিরা, এনবিসি, আরব নিউজ