ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী কেন হঠাৎ পদত্যাগ করলেন
ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ এশতায়েহ ও তাঁর সরকার গতকাল সোমবার পদত্যাগ করেছে। এশতায়েহ বলেছেন, গাজায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও পশ্চিম তীরে সহিংসতা বৃদ্ধির জেরে তিনি পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এই পদত্যাগকে দেখা হচ্ছে ইসরায়েল–ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। তাতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষে সংস্কার আনার বিষয়টি আছে।
তবে একই সঙ্গে এ–ও বলা হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের মধ্যেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা নেই। আবার ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আছে টানাপোড়েন। ফলে এই পদত্যাগেও তেমন পরিবর্তন আসবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের যে পরিকল্পনা, তাতে যুদ্ধের পর ইসরায়েলের দখলে থাকা পশ্চিম তীরের পাশাপাশি গাজার শাসনভার পাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াও চলবে। তবে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার অভাব ও ইসরায়েলের সঙ্গে টানাপোড়েনের সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনায় প্রধান বাধা বলে মনে করা হচ্ছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যে লক্ষ্য, তাতে করে হামাসের পরাজয়ের মধ্য দিয়েই গাজা যুদ্ধের ইতি ঘটবে। তবে যুদ্ধের প্রায় পাঁচ মাসে প্রায় ৩০ হাজার ফিলস্তিনি নিহত ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেও ইসরায়েল ও দেশটির প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সেই লক্ষ্য অধরাই রয়ে গেছে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ কারা
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) গঠন করা হয়। ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন (পিএলও) ও ইসরায়েলের মধ্যকার অন্তর্বর্তীকালীন শান্তি সমঝোতার অংশ হিসেবে গঠিত হয় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। তখন পিএলওর নেতৃত্বে ছিলেন প্রয়াত ইয়াসির আরাফাত।
সেই সমঝোতার অংশ হিসেবে পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ও গাজায় খানিকটা স্বায়ত্তশাসন পায় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। বলা হয়, পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম নিয়ে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ এই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনের এসব ভূখণ্ড দখল করে নেয় ইসরায়েল।
তবে এরপর কয়েক দফা শান্তি আলোচনার পরও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ইসরায়েল বা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতায় আসতে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে মারা যান ইয়াসির আরাফাত। তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহমুদ আব্বাস। পরের বছর হয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ভরাডুবি হয় মাহমুদ আব্বাসের। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় পায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস।
২০০৭ সালে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় এক সপ্তাহ সশস্ত্র লড়াই শেষে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। এতে মাহমুদ আব্বাসের কাছে থাকে শুধু ইসরায়েলের দখল করা পশ্চিম তীরের কিছু অংশের শাসনভার।
এ ঘটনার পর পৃথক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে ফিলিস্তিনিরা যে সশস্ত্র লড়াই করছিল, তার বিরুদ্ধে গিয়ে ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন আব্বাস। তবে জানান, দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়েও তিনি বদ্ধপরিকর। আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনী ইসরায়েলের সেনাদের সঙ্গে মিলে হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে।
ফিলিস্তিন সরকারের পদত্যাগের অর্থ কী
গতকাল পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে মোহাম্মদ এশতায়েহ বলেন, গাজা উপত্যকায় যে ‘নয়া বাস্তবতা’ তৈরি হয়েছে, তাতে নতুন করে সব ঢেলে সাজানো দরকার।
মোহাম্মদ এশতায়েহের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন মাহমুদ আব্বাস। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতি নিয়ে পড়ে আসা মোহাম্মদ মুস্তাফাকে নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হতে পারে। মুস্তাফা বিশ্বব্যাংকে বেশ কিছু জ্যেষ্ঠ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ফিলিস্তিনের বিনিয়োগ তহবিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি ফিলিস্তিনের উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন মুস্তাফা।
ধারণা করা হচ্ছে, এশতায়েহের মতো ফাতাহর অনুগত না হওয়ায় এবং কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকায় মুস্তাফাকে ফিলিস্তিনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাগত জানাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ।
তবে মুস্তাফা প্রধানমন্ত্রী হলেও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেষ সিদ্ধান্তটা নেবেন ৮৮ বছর বয়সী মাহমুদ আব্বাসই। তবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা হলে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ যে শাসনক্ষমতায় সংস্কার আনছে, সেটি পশ্চিমাদের সামনে তুলে ধরা হবে। একই সঙ্গে দেখানো যাবে, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের এই সরকারের গাজা শাসনের মতো যোগ্যতা ও পেশাদারত্ব আছে। যুক্তরাষ্ট্রও এটাই চায়।
ফিলিস্তিনের সরকার পদত্যাগের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব কে দেবে, তা ফিলিস্তিনিদেরই পছন্দ–অপছন্দের ব্যাপার। তবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবিত করার যেকোনো পদক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায়।
ম্যাথু মিলার বলেন, ‘আমরা এসব পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। আমাদের মতে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে গাজা ও পশ্চিম তীরকে আবার এক করার ক্ষেত্রে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে যেভাবে দেখে ফিলিস্তিনিরা
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মাহমুদ আব্বাসের জনপ্রিয়তা অনেকটা কমে গেছে। একের পর এক জরিপে উঠে এসেছে, বেশির ভাগ ফিলিস্তিনিই মাহমুদ আব্বাসের পদত্যাগ চান। অনেক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের দখলদারত্বের ‘ঠিকাদার’ মনে করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে।
দেড় দশক আগে ২০০৯ সালে আব্বাসের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরপরও তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন। নতুন করে নির্বাচন দিচ্ছেন না। নির্বাচন না দেওয়ার কারণ হিসেবে ইসরায়েলের দেওয়া বিধিনিষেধের কথা বলে আসছেন মাহমুদ আব্বাস।
ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। ধারণা করা হচ্ছে, যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে হামাস আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয় পেতে পারে।
নির্বাচন আয়োজনের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে ফিলিস্তিনের সব রাজনৈতিক পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে হামাস। তবে হামাসকে নিয়ে ফিলিস্তিনে কোনো সরকার গঠন হলে ইসরায়েল, তাদের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশ সেটা মেনে নেবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় কী আছে
যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধ শেষে সৌদি আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে। এরপর ধীরে ধীরে বাকি আরব দেশগুলোও স্বীকৃতি দেবে ইসরায়েলকে।
একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা হবে এবং গাজার শাসনভার দেওয়া হবে তাদের হাতে। আর সব কিছু করা হবে, যাতে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষে সংস্কার আনা যুক্তরাষ্ট্রের এই বৃহৎ পরিকল্পনার ছোট একটি অংশমাত্র।