গাজা সীমান্তে ‘ইসরায়েলের চোখ’ যে তরুণীরা

প্রশিক্ষণরত এক ইসরায়েলি নারী সেনাফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজা সীমান্তে ‘ইসরায়েলের চোখ’ হিসেবে পরিচিত তাঁরা। বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত এসব নারী সেনাসদস্যের বছরের পর বছর একটিই কাজ, সেটি হলো গাজা সীমান্ত ঘিরে থাকা ইসরায়েলি নজরদারি ঘাঁটিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে ‘সন্দেহজনক তৎপরতায়’ নজর রাখা।

গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা করার কয়েক মাস আগে থেকেই বিপদের আঁচ করতে পারছিলেন এসব নারী সেনা। তাঁরা বলেন, এই সময়ের মধ্যে সীমান্তের ওপারে অতর্কিত আক্রমণ ও জিম্মি নেওয়ার মহড়ার পাশাপাশি তাঁরা কৃষকদের অদ্ভুত আচরণ করতেও দেখেন।

এসব নারী সেনার একজন নোয়া (প্রকৃত নাম নয়)। তিনি বলেন, সীমান্তের যেকোনো তথ্য তাঁরা গোয়েন্দা সংস্থা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জানান। এটিই তাঁদের কাজ। কিন্তু এ ছাড়া তাঁদের আর কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। নোয়ার ভাষায়, ‘আমরা শুধু দেখতেই পেতাম।’

নোয়ার মতো সীমান্তে নজরদারির কাজে নিয়োজিত এসব নারী সেনার অনেকের ধারণা ছিল যে হামাস ‘বড় কিছু’ করার পরিকল্পনা করছে। নোয়ার ভাষায়, ‘ভেতরে-ভেতরে কিছু একটা চলছিল, যেকোনো মুহূর্তে যার বিস্ফোরণ ঘটবে।’

হামলার আগে সীমান্তে সন্দেহজনক যেসব তৎপরতা তাঁরা দেখেছেন এবং এ বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে যা জানিয়েছেন, তা নিয়ে এসব নারী সেনার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁদের মতে, এ নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত সাড়া পাননি তাঁরা।

হামলার আগের কয়েক মাসে এই নারী সেনারা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে যেসব বার্তা দিয়েছিলেন, সেসব দেখেছে বিবিসি। এসব বার্তায় সীমান্তে নানা তৎপরতা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে অনেককে বিষয়টি নিয়ে নির্দয় ঠাট্টা করতেও দেখা যায়। যেমন ‘অবশ্যম্ভাবী এ হামলা যেদিন হবে, সেদিন কারা এখানে দায়িত্বে থাকবে’?

হামাসের হামলায় সন্তান অর্থাৎ মেয়েদের হারিয়ে শোকাহত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। একই সঙ্গে যেসব বিশেষজ্ঞ সীমান্তে নজরদারির দায়িত্বে থাকা নারী সেনাদের মূল্যায়নে গাফিলতিকে সামরিক বাহিনীর বড় একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতার অংশ মনে করছেন, তাঁদের সঙ্গেও বিবিসি কথা বলেছে।  

গাজা সীমান্তে ইসরায়েলের নির্মিত বেড়া
ফাইল ছবি: এএফপি

এসব বিষয় নিয়ে বিবিসি প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। তবে বলেছে, ‘গাজার সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসকে নির্মূল করাই এখন সামরিক বাহিনীর মূল লক্ষ্য।’

এ নিয়ে ইসরায়েলের সীমান্তে নিয়োজিত সেনা ইউনিটের সাবেক এক কমান্ডার বলেন, সীমান্ত থেকে নানাভাবে তথ্য আসে। এসব তথ্য এক করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাটা হয়েছে তারা (সামরিক বাহিনী) তথ্যগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেনি। যদি যোগসূত্র মেলাতই, তাহলে তারা বুঝতে পারত যে হামাস নজিরবিহীন কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছে।

সীমান্তে নজরদারির দায়িত্বে থাকা ইউনিটগুলোর নারী সেনাদের বয়স কৈশোরের প্রান্তসীমা থেকে ২০-এর কাছে-পিঠে। গাজা সীমান্তে ইসরায়েল যে বেড়া নির্মাণ করেছে, সেখানে অনেকগুলো ইউনিটের ঘাঁটি আছে। এ ছাড়া বেশ কিছু ঘাঁটি আছে সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায়।

ইসরায়েলের এই নারী সেনারা বলছেন, নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। নোয়া বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হলো সব নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া। আমাদের কঠিন একটা কাজ করতে হয়। পালাক্রমে আমরা দায়িত্ব পালন করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। পলক ফেলার বা নজর একটু সরানোর অনুমতি নেই। সব সময় লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হয়।’

সীমান্তে অস্ত্র হাতে এক ইসরায়েলি সেনা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

নজরদারি ঘাঁটিতে দায়িত্ব পালন করেছেন এডেন হাদার। তিনি মনে করতে পারেন তাঁর চাকরি শুরুর পর হামাস যোদ্ধাদের কেবল শরীরচর্চা করতে দেখেছেন। এডেন গত আগস্টে চাকরি ছাড়েন। এর কয়েক মাস আগে তিনি লক্ষ করেন, হামাস যোদ্ধারা রীতিমতো সামরিক প্রশিক্ষণে নেমেছেন।

একই সময়ে অন্য একটি নজরদারি ঘাঁটিতে দায়িত্বরত গাল (প্রকৃত নাম নয়) বলেন, তিনিও সেই সময় সীমান্তের ওপারে হামাস যোদ্ধাদের জোরদার প্রশিক্ষণের বিষয়টি খেয়াল করেছেন। নজরদারি বেলুন দিয়ে এসব দেখেছেন জানিয়ে গাল বলেন, ইসরায়েলি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মতো করে ‘গাজার প্রাণকেন্দ্রে’ একটি অস্ত্র তৈরি করতেও দেখেন তিনি।

নিয়ম অনুযায়ী সীমান্তে নজরদারির দায়িত্বে থাকা এসব নারী সেনা সন্দেহজনক কোনো কিছু দেখলে প্রথমে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। ইউনিট অধিনায়কদের পাশাপাশি কম্পিউটার ব্যবস্থায় এসব তথ্য দিয়ে দেন, যাতে করে এসব তথ্য আরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মূল্যায়ন করতে পারেন।

গাজা সীমান্তে ইসরায়েলের অসংখ্য নজরদারি টাওয়ার আছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া মেজর জেনারেল এইতান দানগত বলেন, সীমান্তে কোনো হুমকি বা ঝুঁকি থাকলে এ নিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নারী সেনাদের নিয়ে গঠিত এসব ইউনিট। সন্দেহ বা উদ্বেগজনক কোনো কিছু দেখলে প্রথমে তাঁরা সেই তথ্য কমান্ডারদের জানান। গোয়েন্দা মূল্যায়নে কমান্ডারদের উচিত তা ওপর মহলকে জানানো।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা এইতান দানগত আরও বলেন, যেকোনো বিপদের পুরো ছবিটা বোঝার ক্ষেত্রে এই পাহারাদারদের দেওয়া টুকরা টুকরা তথ্য খুব কাজে লাগে।

তবে হামাসের হামলার আগের কয়েক মাসে ইসরায়েলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবশ্য ভিন্ন দাবি করছিলেন। প্রকাশ্যে তাঁরা বলছিলেন, হামাসের দিক থেকে হুমকি তাঁরা প্রতিহত করেছেন। তবে সীমান্তজুড়েই বহু আলামত ছিল যে খুবই খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকের কথা। নাহাল ওজ নামক এলাকায় দায়িত্বরত এক নারী সেনা নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অন্য সেনাদের প্রশ্ন করেন, ‘তাই নাকি, আবার কিছু ঘটেছে? তাঁর প্রশ্নের উত্তরে একজন বলেন, ‘তুমি কোথায় ছিলে মেয়ে? দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই কিছু না কিছু একটা ঘটছে।’