বয়স্ক না তরুণ, বিশ্বে নেতৃত্বে কাদের পাল্লা কেমন
যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা লিজ ট্রাস। তাঁর বয়স ৪৭ বছর। শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে ইউরোপে নেতা হিসেবে কম বয়সীদের নির্বাচিত করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে শুধু ইউরোপেই ৫০ বছরের কম বয়সী সরকারপ্রধান আছেন অন্তত ১৪ জন।
বয়স্ক ব্যক্তিরা কি অপেক্ষাকৃত ভালো নেতা? তরুণ নেতারা কি অনেক বেশি আবেগপ্রবণ বা কম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন? নাকি বয়স্কদের চেয়ে তরুণ নেতারা অনেক বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন? এসব নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। সে আলোচনায় যাওয়ার আগে বিশ্বের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানদের বয়সের চিত্রটা দেখে নেওয়া যাক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ষাটোর্ধ্ব রাষ্ট্রপ্রধান যেমন আছেন, তেমনি ৪০ বছরের কম বয়সী রাষ্ট্রপ্রধানও আছেন। যদিও সে সংখ্যাটা কম। ইউরোপসহ বিশ্বে বর্তমানে বেশির ভাগ রাষ্ট্রপ্রধানের বয়স ৬০–এর কোঠায়। তবে বিশ্বে ৫ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান আছেন, যাঁদের বয়স ৩০–এর কোঠায়। তাঁরা হলেন চিলির প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বরিচ (৩৬), মন্টেনেগ্রোর প্রধানমন্ত্রী দ্রিতান আবাজোবিক (৩৭), ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন (৩৭), উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উন (৩৯) এবং এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলে (৩৯)।
২০১৭ সালের মার্চে বিশ্বের সবচেয়ে তরুণ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সেবাস্তিয়ান কুর্জ। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর। তবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত বছরের অক্টোবরে পদত্যাগ করেন তিনি।
২০১৯ সালে ৩৪ বছর বয়সী সান্না মারিনকে দেশের ৪৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেয় ফিনল্যান্ডবাসী। তিনিই তখন বিশ্বের কনিষ্ঠতম সরকারপ্রধান হন। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সান মারিনোর রাষ্ট্রপ্রধান (ক্যাপ্টেনস রিজেন্ট) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আলেসান্দ্রো কারডেলি। মাত্র ২৯ বছর বয়সে দায়িত্ব নিয়ে সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে ওঠেন তিনি। কারডেলির ছয় মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আবারও আগের স্থানে ফেরেন সান্না। তবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ৩৫ বছর বয়সে চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গাব্রিয়েল বরিচ। তিনিই এখন পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রপ্রধান। আর ২০২২ সালের এপ্রিলে ৩৬ বছর বয়সে মন্টেনেগ্রোর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন দ্রিতান আবাজোবিক। তিনি এখন বয়সের হিসেবে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। আর সান্না মারিন বর্তমানে দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।
কম বয়সে আরও যাঁরা রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হয়েছেন
২০১৭ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হন জেসিন্ডা আরডার্ন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৪২ বছর। ২০১১ সাল থেকে উত্তর কোরিয়ার নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কিম জং–উন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৪০ বছরের কাছাকাছি।
২০১৯ সালের জুন মাস থেকে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন মেটে ফ্রেডেরিকসন। বর্তমানে ৪৪ বছর বয়সী এ প্রধানমন্ত্রী যখন দায়িত্ব নেন, তখন বয়স ছিল ৪১ বছর। ২০২১ সালে এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন কাজা কাল্লাস। বর্তমানে তাঁর বয়স ৪৫ বছর।
২০২০ সালে ৪৮ বছর বয়সে মলদোভার প্রেসিডেন্ট হন মাজা সান্দু। বর্তমানে তাঁর বয়স ৫০ বছর। ২০১৫ সালে ৪৮ বছর বয়সে নামিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন সারা কুগংগেলওয়া। বর্তমানে তাঁর বয়স ৫৪ বছর।
সবচেয়ে বেশি বয়সী যাঁরা
বিশ্বে বর্তমানে যতজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান আছেন, তার মধ্যে ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়া সবচেয়ে বেশি বয়সী। তাঁর বয়স ৮৯ বছর। আর সাংবিধানিক রাজতন্ত্রকে বিবেচনায় নিলে কয়েক দিন আগেও বয়োজ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধানের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। গত বৃহস্পতিবার স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে মারা যান তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। এরপর ব্রিটেনের রাজা হয়েছেন রানির ছেলে তৃতীয় চার্লস। তাঁর বয়স ৭৩ বছর।
দেশের জনগণের গড় বয়সের তুলনায় রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের বয়স
২০২১ সালে ২০০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল ওয়ার্ল্ডোমিটারস। দেশের জনসংখ্যার গড় বয়সের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের বয়সের তুলনা করা হয়েছিল। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার গড় বয়স হবে ৩৬ বছর। বর্তমানে তা ৩১ বছর। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের কিছু দেশ বিশেষ করে ইউরোপ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান নির্বাচনে বয়সের প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করছে। যদিও এসব দেশে বেশির ভাগ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের বয়স ৬০–এর কোঠায়।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯টি ইউরোপীয় দেশে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের বয়সের সঙ্গে জনসংখ্যার গড় বয়সের মধ্যে পার্থক্য ১০ বছর কিংবা তারও কম।
আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী মানুষের বসবাস। তবে অঞ্চলটির ৫৪টি দেশের মধ্যে ১৭টি দেশের নেতাদের বয়স ৭০ বছর বয়সের বেশি। এর মধ্যে ৩ জনের বয়স ৮০ বছরের বেশি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারী রাষ্ট্রপ্রধানদের বয়সের মধ্যেও বৈচিত্র্য দেখা গেছে। বর্তমানে ৩৭ বছর বয়সী সান্না মারিন যেমন সবচেয়ে কম বয়সী নারী সরকারপ্রধান, তেমনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (৭৪) সবচেয়ে বেশি বয়সী নারী সরকারপ্রধান।
প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় ১৭টি দেশে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ছিলেন নারী। এর মধ্যে ১১টি দেশের মানুষের গড় বয়স ছিল ৪০ বছরের ওপরে।
ওয়ার্ল্ডোমিটারসের ওই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বয়স্ক মানুষদের আধিক্য থাকা জি–টোয়েন্টিভুক্ত দেশগুলোতে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হিসেবে তরুণ নেতাদের বেছে নেওয়ার প্রবণতা কম। বিশ্বের জন্যসংখ্যার ৭০ শতাংশ এই দেশগুলোতে বসবাস করে। তাঁদের বয়স ৬৫ বছর কিংবা তার ওপরে। জি–টোয়েন্টি দেশগুলোর নেতাদের একটা বড় অংশের বয়স ৬০ ও ৭০–এর কোঠায়।
সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান জি–টোয়েন্টিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান, যাঁর বয়স ৮০ বছরের বেশি।
তরুণ বনাম বয়স্ক, কার উদ্দীপনা বেশি
টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত শতাব্দীতে মানুষের সামগ্রিক জীবনকাল উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। একসময় চলাচলের সক্ষমতা, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি কমে যাওয়াকে বয়স বেশি হওয়ার মাপকাঠি বলে বিবেচনা করা হতো। তবে বর্তমানে অস্থিসন্ধি প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, চোখের ছানি অপসারণ করা হচ্ছে, আবিষ্কার হয়েছে উন্নত শ্রবণযন্ত্র। এতে ৮০ বছর বয়সী মানুষেরাও খুব আনন্দে জীবন কাটাতে পারছেন।
ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতাদের কার্যকারিতা কমে যায়। তবে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে এ তত্ত্ব সাংঘর্ষিক। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, বয়স্ক নেতারা তাঁদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালোভাবে দেশ চালাতে পারেন।
ফোর্বসের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বয়স্ক মানুষদের মধ্যে অহংকার ও আত্মতুষ্টির প্রবণতা বেশি হতে পারে। নিজেদের এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ধারণাকে তাঁরা সাদরে না–ও গ্রহণ করতে পারেন।
সূত্র: দ্য উইক, দ্য কুইন্ট, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ