অভিমত
জান্তার এক হাজার দিন পর যে অবস্থায় মিয়ানমার
মিয়ানমারে এখন শুধু বিভিন্ন গেরিলা গোষ্ঠী নয়, বার্মার তরুণেরাও জান্তাবিরোধী সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমেছে। সেই লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে চীন সীমান্তেও। অনেক অঞ্চলে জান্তার নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় চীনও তার নীতি বদলেছে। পরিস্থিতি বলছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ কাজ করছে। ফলে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ফল এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি আমূল পাল্টে দিতে পারে।
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকারের এক হাজার দিন পার হলো। তিন মাস পর তাদের তিন বছর পূর্ণ হবে। তবে এত দিন টিকে থাকলেও চলতি সময়টা তাদের জন্য তৃপ্তিদায়ক হচ্ছে না। তাদের ভূরাজনৈতিক অভিভাবক গণচীনের জন্যও নয়। বিশেষ করে গত সপ্তাহ থেকে দেখা যাচ্ছে, জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চীন সীমান্তেও ছড়িয়ে পড়েছে, যা চলতি গৃহযুদ্ধে প্রথমবার ঘটল এবং ঘটনা হিসেবে এটা বেশ বিস্ময়কর।
বর্ষা শেষে উত্তপ্ত শীতের প্রস্তুতি
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী জনগণের নির্বাচনী রায় বানচাল করে দেশের শাসনক্ষমতা নেয়। নিজেদের নাম রাখে তারা ‘স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল’। প্রায় তিন বছর ধরে গণতন্ত্রপন্থীরা এই কাউন্সিলের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইতিমধ্যে এই সংগ্রামে প্রায় ১৪ হাজার রাজনৈতিক কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে।
প্রথম বছর এই প্রতিবাদ নির্বাচিত অং সান সু চির সরকারকে কাজ করতে দেওয়ার দাবিতে অহিংস চরিত্রের মিছিল-সমাবেশে সীমিত ছিল। ২০২১ সালের শেষ দিক থেকে আন্দোলন পুরোদস্তুর সশস্ত্র রূপ নিয়েছে। মিয়ানমারে আগে থেকেই শান, কারেন, চিন, কাচিন, আরাকানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বিভিন্ন জাতিসত্তার সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে।
২০২২ সাল থেকে খোদ মূল জনগোষ্ঠী বামার তরুণেরাও অস্ত্র হাতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নামলে এখন প্রায় সব অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা চলছিল, তখন কাকতালীয়ভাবে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে এক অভিনব ঘটনা ঘটে। দুই-তিন দিনের লড়াইয়ে শান এলাকায় জান্তা অনেক সৈন্য ও অস্ত্র হারায়। গেরিলাদের সেই অভিযান এই লেখা (৩১ অক্টোবর) পর্যন্ত চলছিল।
অক্টোবরে বর্ষা শেষ হয়ে নভেম্বরে শীত শুরু হয় মিয়ানমারে। মনে হচ্ছে, এবার জান্তার তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে তীব্র শীতের মধ্যেও সেখানে গোলাবারুদের বেশ উত্তাপ থাকবে।
এক অভিযানে ৪০টি সীমান্তচৌকি হারাল টাটমা-ড
মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শান প্রদেশ, এটি চীনসংলগ্ন। রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক—সব অর্থে এ অঞ্চলে চীনের খুব প্রভাব। এখানকার মানুষ মুঠোফোনে চীনের সিম কার্ড ব্যবহার করে। অর্থনৈতিক লেনদেনে ব্যবহৃত হয় চীনের মুদ্রা।
শান প্রদেশ উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ—তিন ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে উত্তর শানের কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় গেরিলা দল ওয়া আর্মি। এরা মূলত চীন প্রভাবিত। গত দুই বছর মিয়ানমারজুড়ে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ চললেও শান প্রদেশ তুলনামূলক শান্ত ছিল। এর বড় কারণ ওয়ারা জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যায়নি। জান্তার সৈন্যরাও ওয়া এলাকায় সচরাচর খবরদারি করতে যায় না। চীনের প্রভাবেই এই ‘সমঝোতা’ চলছে।
অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও ভারতের তুলনায় নেপিডোতে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক উপস্থিতি ও সক্রিয়তা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্র তার মিয়ানমার নীতিতে বাংলাদেশকে যেভাবে পেতে আগ্রহী, তার ইদানীংকালের অন্যান্য প্রত্যাশার মধ্যে সেই চাওয়ার প্রতিফলন খুঁজে থাকেন ঢাকার অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার। কিন্তু কমবেশি প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে বাংলাদেশ যে এখনো চীনের আশ্বাসের ওপর ভরসা হারায়নি, সেটাই এখনো দেখা যাচ্ছে।
তবে সম্প্রতি উত্তর শানের ওয়াবহির্ভূত এলাকায় নেপিডোর সরকারের সেনাচৌকিগুলোয় ব্যাপক হামলা শুরু হয়। এ হামলার পর গত ২৭ অক্টোবর বিবৃতি দিয়ে যুদ্ধরত উভয় পক্ষকে গোলাগুলি থামিয়ে সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে বলছে চীন।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বিবৃতি বেশ অভিনব। কারণ, জান্তার গত দুই বছরের পোড়ামাটি নীতিতে তারা চুপই ছিল। এখন সংঘাত তার সীমান্ত এলাকা ইউনান পর্যন্ত পৌঁছানোয় তাদের এত দিনকার নীরবতার অবসান হলো কিংবা তারা এ ঘটনায় নিজেদের নিরপেক্ষ হিসেবে দেখাতে চাইছে।
গেরিলা দলগুলো চলতি অভিযানে ইউনান লাগোয়া মুচে, লুকেইং ইত্যাদি এলাকায় জান্তার অনেক সেনাকে হত্যা করেছে এবং টাটমা–ড–এর প্রায় ৪০টি চৌকি দখল করেছে। এসব এলাকা চীনা পণ্য বেচাকেনার জন্য বিখ্যাত। এসব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ পেলে গেরিলা দলগুলো অর্থনৈতিকভাবে সবল হয়ে উঠবে।
জান্তাবিরোধী গেরিলা দলের মধ্যে সমন্বয় বাড়ছে
গত ২৭ অক্টোবর থেকে তিন-চারটি গেরিলা দল সমন্বিতভাবে আক্রমণ শুরু করে। শান প্রদেশের ৫৫টি টাউনশিপের ১২টিতে একই সময়ে হামলা চালানো হয়। এতে ছিল তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ)। এই তিনটিই পৃথক জাতিসত্তার আঞ্চলিক গেরিলা দল। এরা নিজেদের ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ বলে থাকে। দুই বছর ধরে গণতন্ত্রপন্থীদের গড়ে ওঠা বামারদের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এই অভিযানে ছিল বলে দাবি করেছে। এ রকম সব দল তাদের এ অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭’। ২৭ অক্টোবর অভিযান শুরু হচ্ছে বলে এমন নাম দেওয়া হয়েছে।
তিনটি সংগঠনের প্রথম দুটি চীন সীমান্তে সক্রিয়। এদের বিচরণ হচ্ছে তাঙ ও ককাং জাতি–অধ্যুষিত এলাকাগুলোয়। তৃতীয় সংগঠন ‘এএ’ বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন আরাকানে রাখাইন সমাজে সক্রিয়। উত্তর-দক্ষিণের দূরবর্তী গেরিলা দলগুলো যে সমন্বিতভাবে কাজ করছে, তার কারণ তাদের পেছনে রয়েছে সশস্ত্র কাচিনদের মদদ। কাচিন, চিন ও কারেনদের এলাকাগুলো আগে থেকেই জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ফলে শানে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া একদিকে সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যদিকে চীনের জন্য খারাপ বার্তা বটে।
মাঠপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, চীনের দিক থেকে এ অবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ‘টাটমা-ড’ ধীরে ধীরে দেশের বিশাল সীমান্ত পাহারার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। কেবল চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের প্রায় ১ হাজার ৩০০ মাইলের সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে চীন খুবই স্পর্শকাতর। সম্প্রতি এসব এলাকা আন্তদেশীয় অনেক অপরাধচক্রের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে, যা টাটমা-ড দিয়ে দমন করা যাচ্ছে না। পরিবর্তিত অবস্থায় এই সীমান্ত এবং চেক পয়েন্টগুলোর বিষয়ে মিয়ানমারের গেরিলাদের সঙ্গে সমঝোতার নীতি নিয়েছে বেইজিং। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে জান্তার সঙ্গে থেকেও অঞ্চলগতভাবে চীন কৌশল পাল্টাচ্ছে। চীনের এই পরিবর্তন নিশ্চিতভাবে পুরো মিয়ানমারে সরকারবিরোধী গেরিলাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের একটা তরঙ্গ তৈরি করবে।
বহির্বিশ্বের জন্য মিয়ানমারের এই ঘটনাপ্রবাহে কিছু বার্তা আছে। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো এত দিন খবর দিয়েছে, অস্ত্রপাতির অভাবে মিয়ানমারের প্রতিরোধযোদ্ধারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। বাস্তবতা হলো, মুক্তাঞ্চলগুলোয় স্থানীয়ভাবে অস্ত্র তৈরির লোকজ চরিত্রের অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রতিরোধযুদ্ধের এক–চতুর্থাংশ অস্ত্র এভাবে স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়।
আসামের সাংবাদিক রাজিব ভট্টাচার্য বামার এলাকাগুলো ঘুরে এসে এ বিষয়ে গত অক্টোবরে দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীতে সচিত্র প্রতিবেদন লিখে মিয়ানমারের অভ্যন্তরের উদীয়মান বাস্তবতা সবাইকে জানিয়েছেন। এ ছাড়া ‘১০২৭’ অভিযানে ড্রোনের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
চীন লাগোয়া এলাকায়ও লড়াই
তবে কেউ কেউ এমন অনুমানও করছেন, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে চিন, কাচিন ও কারেন সমাজ যে পশ্চিমা বিভিন্ন সংস্থার সহানুভূতি পায়, তারই একটা বিকশিত ছাপ পড়ছে অক্টোবরের ঘটনাগুলোয়।
কারেন, চিন ও কাচিন এলাকাগুলো মূলত খ্রিষ্টান–অধ্যুষিত। এসব সমাজের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের চার্চ-সমাজের যোগাযোগ রয়েছে। টাটমা-ড এসব অঞ্চলে যত বোমা ফেলছে, ঐতিহাসিক ওই ‘যোগাযোগ’ তত নতুন স্তরে চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া পশ্চিমের সুশীল সমাজের নানা সংগঠন মিয়ানমারের এসব অঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে ‘মানবিক সহায়তা’ করতে চায় এবং করে। গৃহযুদ্ধ শুরুর পর পুরোনো সেসব সম্পর্ক নতুনভাবে পুনর্গঠিত হচ্ছে।
কারণ, ‘বার্মা অ্যাক্ট’–এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্রের সংগ্রামের প্রতি একধরনের অঙ্গীকারই প্রকাশ করেছে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের স্বাক্ষর করা ‘বার্মা অ্যাক্ট’ যে বাংলাদেশের ভূমিকারও উল্লেখ করেছে, সেটা বহু আগেই ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিল।
তবে ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের বিভিন্ন আঞ্চলিক গেরিলা দলের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি পুরোনো, সরাসরি ও ঘনিষ্ঠ। চীন বহুবার এসব গেরিলা দলের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আলাপ-আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে। তবে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের মানুষের চীনবিরোধী মনোভাব এবং দেশটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারিক আগ্রহে সামগ্রিক পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।
গত তিন বছরে মিয়ানমারের রাজনীতিমনস্ক তরুণ-সমাজের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। ওই একই সমাজের মধ্যে চীনের ব্যাপারে সন্দেহ-অবিশ্বাস-অনাস্থা অনেক বেড়েছে। তবে এই তরুণদের একটা বড় সমস্যা হলো, অতি বৃদ্ধ ও কারারুদ্ধ অং সান সু চির বিকল্প জাতীয়ভাবে পরিচিতি কোনো নেতা নেই। এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ যে ইউনানের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেল, সেটা বেশ তাৎপর্যবহ।
সবারই জানা, চীনের বঙ্গোপসাগরমুখী অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলোয় শান-ইউনান সীমান্তের গুরুত্ব ঠিক সেই রকম, ভারতের ‘লুক-ইস্ট’ বা ‘অ্যাক্ট-ইস্ট’ কর্মসূচির জন্য মণিপুর শান্ত থাকা যেমনটা দরকার। শান প্রদেশের ভেতর চীনের গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প রয়েছে। এখানে চীন ‘আন্তসীমান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’ করতে চায়। তাদের ‘বিআরআই’ প্রকল্পের অপরিহার্য একটা বিন্দু শান অঞ্চল।
আবার ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’–এর চলতি অভিযানে মান্দালেও অন্তর্ভুক্ত ছিল। নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকেরা বহুকাল মণিপুরের মোরহে থেকে মান্দালে হয়ে সড়কপথে থাইল্যান্ডের মেই সোতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সুতরাং মিয়ানমারের চলতি ঘটনাবলি ভারতেরও গভীর মনোযোগে থাকার কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মানীতি’ কী কাজ করছে
‘স্নায়ুযুদ্ধের’ নতুন কালে এসে চীন ও এশিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের একটা কেন্দ্রীয় উপাদান যে মিয়ানমার, সেটা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোচিত। তবে এই আগ্রহের জন্য মেঠো সমস্যা হলো, একই বিষয়ে থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক আছে। এই তিন দেশের অন্তত একটার ‘উদার সহযোগিতা’ ছাড়া বার্মা অ্যাক্টের প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন দুরূহ।
এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পছন্দ অবশ্যই থাইল্যান্ড। তবে থাই সামরিক আমলাতন্ত্র এমন কোনো ভূমিকা নিতে চায় না, যা মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করে। থাইল্যান্ড হয়তো এও মনে রাখে, বার্মা-অ্যাক্টকে চীন তার ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। থাই সামরিক বাহিনীর এসব বিবেচনার ছাপ আছে দেশটির বেসামরিক সরকারের মিয়ানমার নীতিতে। তারা দশ জাতির আসিয়ান জোটেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে খুব একটা সরব নয়।
একইভাবে ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার উল্টো পিঠে অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের গেরিলা দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে টাটমা-ড–এর সঙ্গে ভারতের এই সহযোগিতার সম্পর্ক পাল্টানোর সুযোগ কম। তা ছাড়া মিয়ানমারে ভারতের বড় কিছু বিনিয়োগও রয়েছে, যা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক দাবি করে।
অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও ভারতের তুলনায় নেপিডোতে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক উপস্থিতি ও সক্রিয়তা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্র তার মিয়ানমার নীতিতে বাংলাদেশকে যেভাবে পেতে আগ্রহী, তার ইদানীংকালের অন্যান্য প্রত্যাশার মধ্যে সেই চাওয়ার প্রতিফলন খুঁজে থাকেন ঢাকার অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার। কিন্তু কমবেশি প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে বাংলাদেশ যে এখনো চীনের আশ্বাসের ওপর ভরসা হারায়নি, সেটাই এখনো দেখা যাচ্ছে।
তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যেভাবে দ্রুত শক্তির ভারসাম্য বদলাচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমার নীতির শক্তিমত্তা প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষ করে চীনের তরফ থেকে মিয়ানমারের প্রান্তিক প্রদেশগুলোর প্রভাবশালী গেরিলা দলগুলোর সঙ্গে জান্তার সমঝোতার যে চেষ্টা ছিল, সেটা কাজ করছে না বলেই ‘১০২৭’ অভিযান থেকে প্রমাণ পাওয়া গেল।
এটা এখন প্রায় স্পষ্ট, চীনের হাতে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের কোনো সমাধান নেই। পাশাপাশি মণিপুর ও শানের সংঘাত এমন কিছু বলছে, যা বাংলাদেশের উত্তপ্ত নভেম্বর থেকে ঠান্ডা মাথায় পাঠ করার দরকার আছে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের ফলাফল দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভূরাজনীতির ছক আমূল পাল্টে দিতে পারে।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক