ফোনকল ধরতে জেন–জি ও মিলেনিয়ালসদের কেন এত অনীহা
বর্তমান তরুণদের মধ্যে ফোনকল ধরার বিষয়ে একধরনের অনীহা দেখা যায়। এই তরুণদের মধ্যে রয়েছে জেন–জি ও মিলেনিয়ালস প্রজন্ম। গত শতকের শেষ ও চলতি শতকের শুরুর দিকে যাঁদের জন্ম, তাঁরাই জেন–জি প্রজন্মের। আর মিলেনিয়ালসদের জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে যোগাযোগের নতুন প্রবণতা নিয়ে লিখেছেন বিবিসির সংবাদকর্মী ইয়াসমিন রুফো। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তা সংক্ষিপ্ত আকারে বাংলা করা হলো।
‘হাই, এটা ইয়াসমিন রুফোর ভয়েসমেইল। দয়া করে এখানে কোনো মেসেজ (বার্তা) পাঠাবেন না। কারণ, আমি তা শুনব না বা আপনাকে ফিরতি কল করব না।’
এটা দুর্ভাগ্য বলতেই হবে, ওপরের কথাগুলো আমার মুঠোফোনের নয়। তবে যদি প্রশ্ন করা হয়, জেন–জি বা মিলেনিয়ালসদের মতো আপনিও কি মুঠোফোনে এভাবে সাফ কথা শুনিয়ে দিতে চান? আমার জবাবটা হবে, অবশ্যই, কেন নয়।
সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়েছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আরউইচ। তাতে ২ হাজার জন অংশ নিয়েছিলেন। ওই জরিপে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী এক–চতুর্থাংশ মানুষই ফোন ধরেন না। তাঁরা জানিয়েছেন, ফোন এলে তাঁরা এড়িয়ে যান, না হয় খুদে বার্তার মাধ্যমে জবাব দেন। আর ফোন নম্বর না চিনলে, ইন্টারনেটে খোঁজ চালিয়ে পরিচয় জানার চেষ্টা করেন।
জেন–জি ও মিলেনিয়ালসদের আগের যে প্রজন্ম রয়েছে, তাদের কাছে ফোনে কথা বলাটা অতি স্বাভাবিক একটি বিষয়। আমার মা–বাবা যখন কৈশোরে ছিলেন, তখন ল্যান্ডলাইন টেলিফোনে কথা বলার জন্য ভাই–বোনের সঙ্গে একপ্রকার লড়াইয়ে নামতেন তাঁরা। আর ফোনটি বাড়ির এমন জায়গায় থাকত যে তাঁদের কথোপকথন পুরো পরিবারই শুনতে পেত।
আমার কৈশোর ছিল এর বিপরীত। ফোনে কথা বলার চেয়ে খুদে বার্তা আমি পাঠাতাম। ১৩তম জন্মদিনে নকিয়ার একটি গোলাপি রঙের ফোন উপহার পেয়েছিলাম। তখন থেকেই বার্তা আদান–প্রদানে আসক্ত হয়ে পড়ি। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বন্ধু–বান্ধবীদের খুদে বার্তা পাঠাতাম।
এই বার্তাগুলো লেখার ক্ষেত্রে একটি মজার বিষয় ছিল। আমরা প্রয়োজন না হলে দুই শব্দের মাঝে স্পেস (ফাঁকা জায়গা) দিতাম না। দরকার না পড়লে স্বরবর্ণও ব্যবহার করতাম না। কারণ, প্রতিটি খুদে বার্তায় সর্বোচ্চ ৬১টি অক্ষর লেখা যেত। আর একটি বার্তা পাঠাতে খরচ হতো ১০ পেন্স করে।
২০০৯ সালে মুঠোফোনে কল করার বিষয়েও ছিল মা–বাবার কড়াকড়ি। বলতেন, ‘দিনরাত বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার জন্য তোমাকে ফোন দেওয়া হয়নি।’ এসব হুমকির কারণেই হয়তো আমাদের প্রজন্ম খুদে বার্তায় আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। বাবা–মায়ের কাছে বিষয়টি এমন ছিল—জরুরি কথা বলার জন্য মুঠোফোন, আর কদাচিৎ দাদা–দাদির সঙ্গে আলাপ করতে ব্যবহার করা যাবে ল্যান্ডলাইন।
মনোবিজ্ঞানী ড. এলেনা তৌরনির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তা হলো তরুণদের মধ্যে মুঠোফোনে কথা বলার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। তাঁরা এখন ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে অস্বস্তিতে ভোগেন। বার্তা পাঠানোই তাঁদের কাছে স্বাভাবিক। তাই তাঁদের ফোনে যখন রিংটোন বাজে বা সাইলেন্ট থাকা অবস্থায় আলো জ্বলতে থাকে, তখন তাঁরা এক অজানা আশঙ্কায় ভোগেন।
আসউইচের জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের অর্ধেকের বেশি জানিয়েছেন, অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ফোনকল এলে, খারাপ খবর পেতে যাচ্ছেন বলে মনে করেন তাঁরা। মনোবিদ এলোইসি স্কিনারের ভাষায়, ‘আমাদের জীবন যতই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফোনকল করার সময় কমে আসছে। ফোনকল হয়ে উঠেছে শুধু জীবনের গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্যই। অনেক সময় খারাপ ও জটিল খবরের জন্যও।’
তবে ফোনে কথা না বলার অর্থ এই নয় যে তরুণসমাজ তাদের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে না। ইন্টারনেটে তারা সারা দিন বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ চ্যাট করে। নানা বার্তা পাঠায়, মজা করেয়, আড্ডা দেয়। এর সঙ্গে সম্প্রতি আবার যুক্ত হয়েছে চ্যাটে ভয়েস নোট (রেকর্ড করা কথা) পাঠানো। আরউইচের জরিপে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশই ভয়েস নোট পাঠাতে পছন্দ করে। অপর দিকে ৩৪ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার মাত্র ১ শতাংশ।
১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সুসি জোনসের মতে, ফোনকলের চেয়ে ভয়েস নোটই তাঁর বেশি ভালো লাগে। কারণ, এর মাধ্যমে বন্ধুবান্ধবের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেওয়ার কোনো চাপও থাকে না। তাই এটা যোগাযোগের আরও মার্জিত একটি উপায়।
তবে আমি সেটা মনে করি না। বন্ধুদের কাছ থেকে আসা পাঁচ মিনিট দীর্ঘ কোনো ভয়েস নোট আমার কাছে পীড়াদায়কই মনে হয়। ভয়েস নোটে তাঁরা কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গ বদল করেন। কথার জড়তায় অনেক সময় নষ্ট হয়। এই কথাগুলো কিন্তু কয়েকটি খুদে বার্তায় বলা যেত।
কর্মক্ষেত্রে ফোনকলের ভয়
৩১ বছর বয়সী আইনজীবী হেনরি নেলসন কেস বলছিলেন, সরাসরি কথোপকথনে নানা শঙ্কা কাজ করে। অনেক সময় প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব পাওয়া যায় না। নিজের দিক দিয়েও তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়ার চাপ থাকে। তাই তিনি ফোনকলে কথা বলা অপছন্দ করেন। ডুনজা রেলিক নামের ২৭ বছর বয়সী আরেক আইনজীবীর মতে, ফোনকলে অনেক সময় নষ্ট হয়।
৬৪ বছর বয়সী জেমস হলটন একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে যেসব তরুণ কর্মীরা রয়েছেন, তাঁরা খুবই কম ফোনকল ধরেন। এই কর্মীরা হয় ভয়েস মেইলে জানিয়ে দেন, তাঁরা ব্যস্ত রয়েছেন, না হয় বলেন, তাঁদের ফোন সাইলেন্ট ছিল, তাই কল গেলেও বুঝতে পারেননি।
এভাবে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা দেখা দেয় বলে মনে করেন জেমস হলটন। তাই তিনি তরুণ কর্মীদের ফোনকলে অনীহার বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ চালিয়ে নিতে চান। তিনি বলেন, ‘কর্মীরা যদি মনে করেন, খুদে বার্তায় যোগাযোগ করাটা তাঁদের জন্য সুবিধার, তাহলে তাঁদের এই পছন্দের প্রতি সম্মান জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
যদিও অনেকে বলছেন, বর্তমানে যোগাযোগের যে নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে জেন–জি ও মিলেনিয়ালসদের ‘অলস প্রজন্ম’ হিসেবেই পরিচিত করছে। তাঁদের এই ধারণা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। এ জন্য ফেরা যেতে পারে ২৫ বছর পেছনে। তখন ফ্যাক্স বাদ দিয়ে ই–মেইলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অনেকেই অনীহা দেখিয়েছিলেন। তবে পরে দেখা যায় ই–মেইলই যোগাযোগ করে আরও সহজ করে তুলেছে। তাই এখন আমাদের ই–মেইলের মতো খুদে বার্তাকেও স্বাভাবিকভাবে বরণ করে নিতে হবে। ভয় ধরানো ফোনকলকে পেছনে ফেলতে হবে ২০২৪ সালেই।