ভারতে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে সংবিধান
ভারতীয় সংবিধানের পুনর্জন্ম ঘটল যেন দীর্ঘ সত্তর বছর পর। কিংবা এভাবেও বলা যেতে পারে, সত্তর বছর পর ভারতীয় সংবিধান যেন নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল। এই পুনর্জন্ম অথবা প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার একমাত্র কারণ নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক তালিকা (এনআরসি)। এই দুই সরকারি উদ্যোগ কতখানি ‘অসাংবিধানিক’, তা প্রমাণে মানুষ হাতে তুলে নিয়েছে ভারতীয় সংবিধান। বলতে গেলে সংবিধানই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদের চরিত্র ও হাতিয়ার।
গতকাল রোববার প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে দেশীয় সংবাদপত্রগুলোয় ভারতীয় সংবিধানের ‘প্রিএমব্লেম’ বা ‘প্রস্তাবনা’ যেভাবে ছাপা হয়েছে, যেভাবে আবালবৃদ্ধবনিতা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেই প্রস্তাবনা পাঠের মধ্য দিয়ে সংবিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে, গত সত্তর বছরে তা দেখা যায়নি। সিএএ ও এনআরসির বিরুদ্ধে আন্দোলন যত তীব্রতর হচ্ছে, ততই হাতে হাতে উঠে আসছে সংবিধান। সংবিধানই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদের ভাষা।
এক মাস ধরে ভারতের রাজ্যে রাজ্যে সিএএ ও এনআরসিবিরোধী সমাবেশে বিক্ষোভকারীদের হাতে হাতে ঘুরেছে ভারতীয় সংবিধানের প্রতিলিপি। একের পর এক সমাবেশে নিয়ম করে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করা হয়েছে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা জামিয়া মিলিয়া কিংবা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শহরের আইআইটি অথবা দিল্লির শাহিনবাগ ও জামে মসজিদের সমাবেশ—সর্বত্রই এক মাস ধরে বিক্ষোভকারীরা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছেন। সিএএ যে ‘সংবিধানবিরোধী’, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান যে সংবিধান লঙ্ঘনকারী, সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে দেশের কোণে কোণে।
গতকাল প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন তাই জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি প্রতীকী হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
শুধু এই নয়, ভারতীয় সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো বিভিন্ন স্কুলের শিশুরা ছবির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছে। যেমন গণতন্ত্র বোঝাতে আঁকা হয়েছে ভোটদানের ছবি, সাম্য বলতে ঢেঁকির দুদিকে বসা দুই শিশু, স্বাধীনতা বোঝাতে উজ্জ্বল উড়ন্ত পায়রা, সৌভ্রাতৃত্ববোধ বোঝাতে বিভিন্ন ধর্মের শিশুদের হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। ভারতীয় সংবিধান যে ধারণা ও বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছে টি–শার্টেও। বিভিন্ন সংস্থা বুকে–পিঠে প্রস্তাবনা লিখে বিক্রি করেছে সেসব টি–শার্ট। সামাজিক মাধ্যমগুলোয় ছেয়ে গেছে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা। সংবিধানের এমন সর্বজনীন চর্চা গত সত্তর বছরে দেখা যায়নি।
>সিএএ–এনআরসি নিয়ে ক্ষোভ
প্রজাতন্ত্র দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংবিধান রক্ষার শপথ
গত ৭০ বছরে এমন দেখা যায়নি
চেতনার এই উন্মেষের পাল্টা হিসেবে ভারতের শাসক দল বিজেপি মেলে ধরছে দেশপ্রেম। আসন্ন দিল্লি নির্বাচনকেও শাসক দল করে তুলেছে দেশপ্রেম বনাম দেশদ্রোহের লড়াই। গত শনিবার দিল্লির এক নির্বাচনী প্রচারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হুংকার দিয়ে বলেছেন, ভোটের দিন এত জোরে পদ্মফুলের বোতাম টিপুন, যাতে গোটা শাহিনবাগ ভেসে যায়। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারে এই শাহিনবাগে স্থানীয় মানুষজন এক মাসের বেশি সময় যাবৎ সিএএ ও এআরসির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছে। বিজেপির নেতারা এসব আন্দোলনকারী ও তাঁদের সমর্থকদের ‘পাকিস্তানি এজেন্ট’ বলতে ছাড়ছেন না। এঁদের বিরুদ্ধে লড়াইটাই বিজেপির ভাষায়, দেশপ্রেমিক বনাম দেশদ্রোহী।
সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনা ও সারা দেশের জন্য এনআরসি তৈরির অঙ্গীকার আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের চাপ অবশ্য বাড়িয়েই যাচ্ছে। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও চীনের যাবতীয় উদ্যোগ ফলপ্রসূ না হলেও দিন কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের এক প্রথম সারির দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে, নেপালও নাকি মধ্যস্থতার পক্ষে। সেই দেশের এক শীর্ষ কূটনীতিক ওই পত্রিকাকে জানিয়েছেন, নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে প্রয়োজনে নেপাল সেই দায়িত্ব পালন করতে পারে। নেপাল এমনকি এ কথাও বলেছে, তারা সার্কের পুনরুজ্জীবন চায়। খবরটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নেপালের ওপর চীনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। চীনের প্রভাব বাড়ার অর্থ ভারতের প্রভাব কমা।
সিএএ নিয়ে ভারতের আরও একটা বড় ধাক্কা আসতে চলেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মারফত। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ১৫৪ জন সদস্য এক প্রস্তাবে মনে করছেন, ‘সিএএ বিশ্বে রাষ্ট্রহীনতার পক্ষে সবচেয়ে বড় সংকট এবং মানুষের দুর্দশার একটা বড় কারণ।’ ব্রাসেলসে আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্টের অধিবেশনে এই প্রস্তাব পেশ হওয়ার কথা।
ভারতের বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দল যে যে কারণে সিএএর বিরোধিতা করছে, যে জন্য প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠের মধ্য দিয়ে দেশরক্ষার শপথ নিচ্ছে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই প্রস্তাবে হুবহু তারই প্রতিধ্বনি। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডা প্রতিষ্ঠারই এক হাতিয়ার সিএএ। এই আইন ধর্মীয় বৈষম্য সৃষ্টিকারী। বিভাজনকামী।’
শাসক দল বিজেপি তবু নির্বিকার। বিরোধীরা সংবিধান আঁকড়ে আন্দোলনের তীব্রতা যত বাড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে সরকারের জেদ। সিএএ প্রত্যাহারের কোনো ইঙ্গিত সরকার এখনো দেখায়নি। এনআরসি তৈরি করা হবে না, সে কথাও বলেনি। সরকার বরং চাইছে, বল প্রয়োগের মাধ্যমে সিএএসংক্রান্ত যাবতীয় প্রতিরোধ চুরমার করে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের মামলা আনতে। সেই প্রচেষ্টা শুরুও হয়েছে।