বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায় জন-আস্থা অর্জনের চেষ্টায় ভারত

শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা এই দ্বীপরাষ্ট্রে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেছেছবি: রয়টার্স

ভারত মহাসাগরে কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গত ১৫ বছর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অনুকূল কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের জন্য পাল্লা দিয়ে লড়েছিল ভারত ও চীন। এ লড়াইয়ে চীন জনমতের দৌড়ে ভারতকে পেছনে ফেলে দেয়। তবে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা এই দ্বীপরাষ্ট্রে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেছে বলে মনে করছে বিবিসি।

ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের দামে উল্লম্ফন এবং খাদ্য ও জ্বালানির সংকটের কারণে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ায় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশটি।

গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর তাঁর সমর্থকেরা হামলা করলে ৯ মে রাতভর সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তিনি বলেছেন, ইতিবাচক ধারায় ফেরার আগে কিছু সময়ের জন্য দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হবে।

ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। চীনের মতো ভারত কখনো শ্রীলঙ্কার বড় ঋণদাতা ছিল না। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের ১০ শতাংশের কিছু বেশি ছিল চীন থেকে নেওয়া।

এরপর ২০২১ সালের শুরুর দিকে অর্থনৈতিক সংকট আঁচ করতে পেরে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় সংকট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কার সরকার মুদ্রা বিনিময় সুবিধার অংশ হিসেবে চীন থেকে আরও ১০ বিলিয়ন ইউয়ান (১৪৮ মিলিয়ন ডলার) ঋণ নেয়।

তবে সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় আর্থিক সংকটের পর ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার সহায়তায় সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী হিসেবে অবস্থান তৈরি করছে ভারত।

কলম্বোর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছর এ ঋণের সাত বিলিয়ন ডলার শোধ করতে হবে। আগামী বছরগুলোতেও একই পরিমাণে শোধ করে যেতে হবে।

জ্বালানির মতো আবশ্যকীয় আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য দেশটি তিন বিলিয়ন ডলারের জরুরি ঋণও চেয়েছে। বিশ্বব্যাংক ৬০০ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছে। ভারত ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমদানির জন্য অতিরিক্ত আরও ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারও ধার দিতে পারে ভারত।

এদিকে ভারত ইতিমধ্যে ৬৫ হাজার টন সার ও ৪ লাখ টন জ্বালানি পাঠিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। মে মাসের শেষ নাগাদ আরও জ্বালানি সরবরাহ পৌঁছানোর কথা রয়েছে। আরও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোরও অঙ্গীকার করেছে দিল্লি।

বিপরীতে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনকে ব্রিটিশ নির্মিত ত্রিনকোমালি ট্যাংক ফার্ম ব্যবহারের সুযোগ দিতে চুক্তি করে নেয় ভারত। ত্রিনকোমালিতে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণ করতে পারে দিল্লি।

ভারতের সহায়তার বিষয়ে মিশ্র অনুভূতি

শ্রীলঙ্কার অনেকেই মনে করেন, কলম্বোয় ভারতের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি মানে দেশটির ‘সার্বভৌমত্ব দুর্বল হওয়া’। ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির পাবুদা জয়াগোদা বলেন, ‘দেড় বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সংকট চলছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ভারত এটাকে ব্যবহার করেছে বলে আমরা মনে করি। হ্যাঁ, তারা কিছু ঋণ দিয়েছে, কিছু মেডিকেল সরঞ্জাম ও খাদ্য সরবরাহ করেছে, তবে বন্ধু হিসেবে নয়। এখানে গোপন রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা রয়েছে।’

তবে অন্যরা ভারতীয় সহায়তার বিষয়ে অনেক বেশি ইতিবাচক। কলম্বোর পেঁয়াজ আমদানিকারকদের একজন ভি রত্নসিংহাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্ভোগের জন্য ভারত দায়ী নয়। আমরা এখনো সুলভ মূল্যে তাদের কাছ থেকে পেঁয়াজ পাচ্ছি। সংকটের সময় আমাদের ঋণ দিচ্ছে। পেঁয়াজের দাম তিন গুণ হওয়ার ব্যর্থতা শ্রীলঙ্কা সরকারের।’

হামবানটোটা বন্দর ও কলম্বো-গল এক্সপ্রেসওয়ের মতো আরও অনেক অবকাঠামোগত প্রজেক্ট চীনকে দেওয়া হয়
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু চীনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের কারণে এখন ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে শ্রীলঙ্কা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাড়াতে তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে এ পথে হাঁটতে শুরু করে রাজাপক্ষে সরকার।

হামবানটোটা বন্দর ও কলম্বো-গল এক্সপ্রেসওয়ের মতো আরও অনেক অবকাঠামোগত প্রজেক্ট চীনকে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কলম্বো সফর ছিল দিল্লির প্রতি সুস্পষ্ট কূটনৈতিক বার্তা।

হামবানটোটাকে আজকাল সচরাচর ‘শ্বেতহস্তী’ বলে অভিহিত করা হয়, যার কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে এ রক্তক্ষরণ। একই ঘটনা ঘটেছে আরও কয়েকটি ব্যয়বহুল প্রকল্পের ক্ষেত্রেও, যা শ্রীলঙ্কাকে চীনের ঋণজালে আটকে ফেলেছে।

কলম্বো শহরের গলে ফেইস গ্রিনের অনেক সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে দ্রুত আধুনিকায়নের এ চেষ্টাই শ্রীলঙ্কাকে বর্তমান পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার ঋণ ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এ ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে প্রথমে ইউয়ানের সঙ্গে রুপির বিনিময়ে রাজি হয়েছিল চীন। পরে কলম্বো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাহায্য চাইলে নিজেদের অসন্তোষের কথা জানায় বেইজিং।

মাহিন্দা রাজাপক্ষের ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগ দাবিতে কলম্বোর গলে ফেইসে অন্য বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাঁবু টানিয়ে সপরিবার অবস্থান করছেন নুরা নুর (৪৪)। তিনি বলেন, ‘চীন থেকে আসা সব অর্থের কখনো কোনো হিসাব রাখা হয়নি, ঠিক কি না। তাহলে ওই ঋণ পরিশোধে কেন আমার দেশ খেলাপি হবে? এখন সব সরবরাহ আসছে ভারত থেকে। তাই আমার প্রশ্ন, কাকে আমাদের বিশ্বাস করা উচিত—চীন নাকি ভারতকে?’

কূটনীতি কাজে দেবে, এখনো অনেকে সে আশায় আছেন। দ্য আইল্যান্ড পত্রিকায় ভারতে নিযুক্ত শ্রীলঙ্কার সাবেক হাইকমিশনার অস্টিন ফার্নান্দো লিখেছেন, ‘শ্রীলঙ্কাকে কি চীনের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? যদি এমনটি হয়, অন্য নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সে কারণে এমন সম্ভাব্য পরিণতি আমাদের এড়িয়ে যাওয়া প্রয়োজন।’

ভারতের প্রচেষ্টা

ভারত নিজেদের প্রতিবেশী মনে করে, এমন দেশগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সঙ্গে পাল্লা দিতে কঠোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের পরের বছরই কলম্বোয় যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুধু সফর করেই ক্ষান্ত থাকেননি, শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে ‘সবচেয়ে ভালো বন্ধু’ বলেও দাবি করেন তিনি।

শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার অর্জুনা রানাতুঙ্গা মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর দায়িত্ব পালনকালে ভারতের উদারতার কথা স্বীকার করেন তিনি।

রানাতুঙ্গা বলেন, ‘আমি ২০১৫ সালে পেট্রোলিয়াম ও বন্দর—এই দুই মন্ত্রণালয়ই চালিয়েছি। তহবিলের অভাবে জাফনা বিমানবন্দর নির্মাণে আমরা হিমশিম খাচ্ছিলাম। আমি সহায়তার জন্য দিল্লিতে যাই। প্রধানমন্ত্রী মোদির সরকার স্বল্প সুদের ঋণের প্রস্তাব দেয়। পরে তা অনুদানে পরিণত করা হয়। প্রতিবেশীর কাছ থেকে তুমি এর চেয়ে বেশি কী আসা করতে পারো?’

এরপর ২০১৯ সালে আবার রাজাপক্ষে পরিবার ক্ষমতায় ফেরে। এ সময় গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট আর মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রী হন। এ প্রেক্ষাপটে ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির বিকল্পগুলো আবার সাজায়। জ্বালানি ও খাদ্যপণ্য নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে নতুন চুক্তিগুলো স্বাক্ষর করে। চীনের কাছ থেকে তেমন প্রতিক্রিয়া ছাড়াই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে সফর হয়।

ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলাপের একেবারে পুরোভাগে ছিল শ্রীলঙ্কার তামিল সংখ্যালঘু প্রশ্ন ও তাদের অধিকারের বিষয়গুলো। ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধ অবসানের পর শ্রীলঙ্কার সরকারের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়ায় ভারত। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ তামিলসহ দেশের সব প্রদেশের ক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে ১৯৮৭ সালের ভারত-শ্রীলঙ্কা শান্তি চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন করেনি কলম্বো।

তবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট দুই দেশের মধ্যে অন্য সব রাজনৈতিক উদ্বেগকে ছাড়িয়ে গেছে। ভারত থেকে আবশ্যকীয় নিত্যপণ্যের অব্যাহত সরবরাহের ফলে শ্রীলঙ্কায় জনমতে পরিবর্তন এসেছে। একসময় তাদের ভারতবিরোধী ও চীনপন্থী মনে করা হতো।

আরও পড়ুন

কলম্বোর সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ভবানি ফনসেকা বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর আগে চীনের পেছনে পড়ে যায় ভারত। তবে এখন বেশ ভালোভাবেই ফিরে আসার কঠোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।’

ভবানি ফনসেকা বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুরা তাদের সম-অধিকারের দাবিদাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতকে সব সময় ইতিবাচক হিসেবে পায়। অন্যদিকে সিংহল সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে এখনো মিশ্র ধারণা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপে অনেকে উদ্বিগ্ন। তবে আমি মনে করি, গত কয়েক সপ্তাহে তা পুরোপুরি বদলে গেছে।’