প্রসাধনীর সাম্রাজ্য গড়ে সেরা ধনীর তালিকায় ফাল্গুনী
ব্যাংকে কাজ করেছেন ১৮ বছর। হঠাৎই একদিন সেই দায়িত্ব ছেড়ে ফ্যাশন ও সৌন্দর্যপণ্যের অনলাইন বিপণি তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। ২০১২ সালে শুরু করে দিলেন নতুন ব্যবসা। তখনো স্থানীয় দোকান থেকে প্রসাধনসামগ্রী কেনায় অভ্যস্ত ছিলেন বেশির ভাগ ভারতীয়। তবে অনলাইন শপিংয়ের ব্যাপারেও অল্পস্বল্প জানাশোনা ছিল তাঁদের। আর এমন একটা সময়েই প্রসাধনসামগ্রীর ই-কমার্স সাইট ‘নায়কা’ শুরু করেন ফাল্গুনী নায়ার। চলতি মাসে নায়কা শেয়ারবাজারে আসে। এসেই বাজিমাত। কোম্পানির অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। আর এর মধ্য দিয়ে নিজের একক কৃতিত্বে বিশ্বের সেরা ধনীদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ফাল্গুনী। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ৫৮ বছর বয়সী সাবেক এই ব্যাংকার এখন ভারতের অন্যতম স্বপ্রতিষ্ঠিত ধনী নারী।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আহমেদাবাদের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে পড়াশোনা করেছেন নায়ার। নায়কা প্রতিষ্ঠার আগে একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১২ সালে ৫০তম জন্মদিনের কয়েক মাস আগে নিজের সংস্থা খোলার কথা ভাবেন। ব্র্যান্ডের নাম বেছে নেন সংস্কৃত শব্দ ‘নায়কা’ থেকে। সংস্কৃত ভাষায় ‘নায়িকা’ অর্থ শ্রেষ্ঠ নারী, রূপে-গুণে-ব্যক্তিত্বে যিনি অনন্যা। আর সংস্কৃত শব্দ নায়কা-এর অর্থ হলো ‘অভিনেত্রী’। ভারতীয় নারীদের সাজিয়ে তোলার ভার নেয় ফাল্গুনী নায়ারের সংস্থা। এখন তাঁর অনলাইন সাইটে চার হাজারের বেশি ব্র্যান্ডের প্রসাধনসামগ্রী আছে। গত মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে আয় করেছেন ২ হাজার ৪৫০ কোটি রুপি।
এনডিটিভির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১২ সালে ফাল্গুনী যখন নায়কা প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৫০ বছরের কাছাকাছি। পাড়ার দোকান থেকে খুব দেখেশুনে, যাচাই-বাছাই করে প্রসাধনী কেনায় যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁদের ই-কমার্স সাইটে উদ্বুদ্ধ করার কাজটা সহজ ছিল না। অনলাইনে প্রসাধনসামগ্রী বিক্রির জন্য বলিউড তারকাদের দিয়ে ডেমো ভিডিও তৈরি করে তা প্রচার করা হতো। অনলাইনের পাশাপাশি ৭০টির বেশি ছোট দোকানেও প্রসাধনী বিক্রি করতে থাকেন তাঁরা। ত্বকের মৃত কোষ দূর করার ক্রিম, বিয়ের কনের রূপসজ্জায় ব্যবহৃত সামগ্রী, শত শত শেডের লিপস্টিক, ফাউন্ডেশন, ভারতীয়দের ত্বক ও স্থানীয় আবহাওয়ার ব্যবহারের উপযোগী নেইল কালার বিক্রি করে থাকে নায়কা।
নায়কা একটি লাভজনক কোম্পানি। এ সপ্তাহে মুম্বাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে নায়কার প্যারেন্ট কোম্পানি এফএসএন ই-কমার্স ভেঞ্চারস। তখন থেকে তাদের শেয়ারের দর বাড়তে শুরু করে। ইস্যু মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে শেয়ারের দাম। এতে কোম্পানির অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যা ২০২০ সালে তাদের ব্যক্তিগত তহবিলের তুলনায় ১১ গুণ বেশি। তা ছাড়া ফাল্গুনী নায়ারের কোম্পানির নিট সম্পদের মূল্য ৭০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আগে কোম্পানিটির নিট সম্পদের মূল্য ছিল ১০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। ইন্টারনেটভিত্তিক কোনো কোম্পানির শেয়ারবাজারে ঢোকার এমন ঘটনা খুব বিরল বলে উল্লেখ করেছে এনডিটিভি।
নায়ারের জন্ম গুজরাটি পরিবারে। বাবার একটি ছোট বিয়ারিং কোম্পানি ছিল। বাবাকে সহযোগিতা করতেন তাঁর মা। ফাল্গুনী নায়ারের ব্যবসার প্রতি ঝোঁকটা যেন জন্মসূত্রেই পাওয়া। ২০১৭ সালে ইকোনমিক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফাল্গুনী বলেছিলেন, যেকোনো ব্যবসার জন্য প্রথম বছরটি মধুচন্দ্রিমার সময়ের মতো। এ সময়টা পরিকল্পনা আর নকশা করতে করতেই কেটে যায়। পরের বছরটি ব্যবসার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নিজের ব্যবসায়িক উদ্যোগের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ভারতের অন্যতম এই ধনকুবের বলেন, ‘যে ব্যক্তিকে কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি দিনে ৩০টি অর্ডার সামলে উঠতে না পেরে কাজ ছেড়ে দেন। কীভাবে পণ্যসামগ্রী প্যাকেটে ভরে তা পাঠাতে হয়, সেটা আমাদের শিখতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হয়েছে আমাদের।’
ফাল্গুনী জানান, ব্যবসা শুরুর পর প্রথম দুই বছর সম্পূর্ণ পারিবারিক তহবিলে সেটি চলত। তিনি এবং তাঁর স্বামী সঞ্জয় নায়ার মিলে অর্থের জোগান দিতেন। এখন নায়কার দুটি পারিবারিক ট্রাস্ট ও সাতজন বিনিয়োগকারী আছেন। নায়ারের ছেলে ও মেয়ে নায়কার ভিন্ন ভিন্ন ইউনিট পরিচালনার ভার সামলাচ্ছেন।
ব্লুমবার্গ সূচক অনুযায়ী, ফাল্গুনী নায়ার অন্যতম স্বপ্রতিষ্ঠিত ধনী নারী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও সার্বিকভাবে অন্যতম ধনী নারীর স্থানটি ও পি জিন্দাল গ্রুপের চেয়ারপারসন সাবিত্রী জিন্দালের দখলেই রয়েছে। তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত নন। ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক ও পি জিন্দাল গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাবিত্রীর স্বামী। সাবিত্রীর কোম্পানির নিট সম্পদের মূল্য প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
গত বছর আরও ধনী হয়েছেন ভারতের ধনকুবেররা
করোনা মহামারির কারণে অনেক ভারতীয়কে কর্মচ্যুত হতে হয়েছে। তবে গত বছরটি ভারতের অতিধনীদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। তাঁরা আরও ধনী হয়েছেন। ব্লুমবার্গের সূচক অনুযায়ী, রিলায়েন্সের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানির সম্পদের মূল্য এখন ৯ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি, যা এক বছর আগের তুলনায় ২ হাজার কোটি ডলার বেশি। তাঁর কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছেন আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি। তাঁর সম্পদের মূল্য এখন ৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি।
ভারতীয় প্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্যও গত বছরটি খুব সাফল্যের। চলতি বছরের শুরুতে খাবার ডেলিভারিতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান জোমাটো প্রথম ভারতীয় টেক ইউনিকর্ন মর্যাদা পেয়েছে। যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মূল্য ১০০ কোটি ডলারের বেশি, তাদের এ খেতাব দেওয়া হয়।
নায়কা ছাড়াও চলতি মাসে ভারতের শেয়ারবাজারে আত্মপ্রকাশকারী আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান হলো পেটিএম। কোম্পানিটি ২৫০ কোটি আইপিও ছেড়েছে। বর্তমানে নায়কা বিক্রি করে দেড় হাজার ব্র্যান্ডের প্রায় চার হাজার রকমের ফ্যাশন ও সৌন্দর্যপণ্য। ওয়েবসাইট অ্যাপের পাশাপাশি ভারতজুড়ে তাদের ৮০টি সাধারণ বিপণি রয়েছে। এমনকি রয়েছে নিজেদের ব্র্যান্ডের পণ্যও।
ব্লুমবার্গের ধনকুবের সূচকের হিসাব বলছে, ১০ নভেম্বরের শেয়ারবাজারের হিসাব জানিয়ে দিয়েছে, ফাল্গুনীর সংস্থার শেয়ারের দাম বেড়েছে প্রায় ৮৯ শতাংশ। ভারতের প্রথম নারী পরিচালিত সংস্থা এটিই, যা স্টক মার্কেটে বড় প্রভাব ফেলেছিল। নিজের উদ্যোগে যাঁরা শীর্ষে পৌঁছেছেন, ভারতে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী নারী ফাল্গুনী নায়ার। তবে এসবই তো সংখ্যামাত্র। এর চেয়ে অনেক বড় কৃতিত্ব অর্জন করে ফেলেছেন নায়ার। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বয়স, লিঙ্গপরিচয়—কোনো কিছুই ইচ্ছাপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বাধা দিতে পারে না শীর্ষে পৌঁছানোর লক্ষ্যেও। নিজের চলা পথে আরও অনেক নারীর ইচ্ছার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন ফাল্গুনী।