ছত্তিশগড়েও কর্ণাটকি নাটকের সম্ভবনা
শুরু হলো ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের দ্বিতীয় দফার ভোট। ৯০ আসনের বিধানসভার প্রথম দফায় নকশালপন্থীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত বিস্তীর্ণ বস্তার এলাকার ১৮টি আসনে ভোট হয়েছিল ১২ নভেম্বর। আর আজ মঙ্গলবার শুরু হলো বাকি ৭২ বিধানসভার ভোট। এই কেন্দ্রগুলোই ঠিক করে দেবে আরও পাঁচ বছরের জন্য বিজেপি রাজ্যটি দখলে রাখবে, নাকি প্রবল আশায় বুক বাঁধা কংগ্রেসের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে মাথাচাড়া দেবে ভোটের ঠিক আগে গড়ে ওঠা তৃতীয় জোট? সরকার গড়তে হয়ে উঠবে নির্ণায়ক?
ছত্তিশগড়ই একমাত্র বিজেপি-শাসিত রাজ্য, যেখানে ভোটে জিততে শাসক দল নরেন্দ্র মোদির ওপর নির্ভরশীল নয়। ১৮ বছর বয়সী এই রাজ্যের সবচেয়ে উঁচু মাথা ১৫ বছর ধরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিং। ডাক্তারি ছেড়ে রাজনীতিতে ঢোকা এই ‘অজাতশত্রু’র দিকেই চেয়ে আছে বিজেপি। রমণ সিংয়ের ভাবমূর্তিই শাসক দলের ভরসা।
তবে লড়াইটা এবার ভিন্ন। এই প্রথম তিন শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে রাজ্য রাজনীতি। একদিকে শাসক বিজেপি, অন্যদিকে তাঁর প্রবল প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে তৃতীয় শক্তি হিসেবে এই প্রথম মাথা তুলেছে সাবেক কংগ্রেসি ও রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগীর দল ছত্তিশগড় জনতা কংগ্রেস, দলিত নেত্রী মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) ও সিপিআই। প্রধান দুই দলের কাছেই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যোগী, মায়াবতী ও সিপিআইয়ের জোট। বিজেপি, না কংগ্রেস, এই জোট কার বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে চলেছে এখন, তা গবেষণার বিষয়।
আর তাই ভোট শেষে ছত্তিশগড়েও কর্ণাটকি নাটক মঞ্চস্থ হবে—এমন একটা সম্ভাবনা মাথা চাড়া দিচ্ছে।
ছত্তিশগড়ের জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ তফসিল জাতি ও অনগ্রসর এবং ৩১ শতাংশ উপজাতি। অথচ জনপ্রিয়তম মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিং জাতে রাজপুত, যাঁদের সংখ্যা রাজ্যে ২ শতাংশেরও কম। জাতপাত-দীর্ণ আর্যাবর্তে এই উদাহরণ প্রায় নেই বললেই চলে। রমণ সিংয়ের এই গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র কারণ সব বিষয়ে রাজনীতিকে টেনে না আনা এবং প্রশাসনে নিরপেক্ষতা রক্ষা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে গত ১৫ বছরে ছত্তিশগড়ের যন্ত্রণা তিনি ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন। বরং বলা যেতে পারে, জাহির করার মতো কৃতিত্ব দাবি তাঁর পক্ষে প্রায় বিরল। রাজ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস এখনো প্রায় ৪৮ শতাংশের। ১৮ বছর আগে রাজ্য গঠনের সময় এই হার ১ শতাংশ কম ছিল। মানব উন্নয়ন সূচকগুলোর নিরিখে রাজ্যের অবস্থান ২৩ নম্বরে। মাথাপিছু আয় মাসে আট হাজার টাকারও কম। নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ, যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার সাড়ে ১২ শতাংশ। রাজ্য গঠনের সময় নকশালপন্থী প্রভাব ছিল ৮ জেলায়, আজ তা ১৮টি জেলাকে গ্রাস করেছে। এই সংখ্যাতত্ত্ব সত্ত্বেও রমণ সিং তাঁর দলের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নেতা। তাঁকে ঘিরেই আশায় রয়েছে বিজেপি।
ছত্তিশগড়ে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে ভোট ব্যবধান কখনো ২ শতাংশের বেশি হয়নি। গত বিধানসভা ভোটে তো কংগ্রেসের তুলনায় বিজেপি পেয়েছিল মাত্র দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি ভোট। মাত্র এক থেকে দেড় শতাংশ ভোটের হেরফের পালাবদল ঘটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষমতাসীন বিজেপিকে সরাতে কংগ্রেস যখন আশার জাল বুনছিল, তখনই যোগী-মায়াবতীর মিলন। এই জোট প্রাথমিকভাবে বিজেপিকে উৎফুল্ল করেছিল। কারণ, তারা ভেবেছিল, শাসক দলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কংগ্রেসের মতো এই নতুন জোটেও ভাগাভাগি হয়ে যাবে। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, বিজেপির বলিরেখাও গাঢ় হয়েছে। কংগ্রেসের মতো চিন্তিত তারাও। কার ভোট নয়া জোট বেশি টানবে, সেই গবেষণা অন্তহীন। অথচ গত নির্বাচনে এই ৭২টি আসনের মধ্যে বিজেপি দখল করেছিল ৪৩টি।
রাজ্য রাজনীতির এই নয়া মেরুকরণ সহসা জন্ম দিয়েছে ছত্তিশগড়ে কর্ণাটকি নাটকের পুনরাভিনয়ের সম্ভাবনার। কর্ণাটকে বিজেপি বৃহত্তম দল হলেও ক্ষমতা দখল করতে পারেনি তৃতীয় স্থানে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দলকে (জেডিএস) কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ায়। ‘সি-ভোটার’-এর শেষ জরিপ অনুযায়ী যোগী, মায়াবতী ও সিপিআইয়ের জোট ২০ শতাংশ ভোট ও ১২-১৫টি আসন পেলে খেলাটা ঘুরে যেতে পারে। কে বলতে পারে, তখন বিজেপিকে ঠেকাতে রাহুল গান্ধী তাঁর পুরোনো সহযোগী অজিত যোগীকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনের দিকে এগিয়ে দেবেন না?
সেই সম্ভাব্য ফলের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছেন অজিত যোগী। নতুন রাজ্যগঠনের পর কংগ্রেসের নেতা হিসেবে তিনিই ছিলেন ছত্তিশগড়ের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয় দফায় আরও একবার সেই সম্মান পেতে মুখিয়ে আছেন রাজ্যের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই নেতা।