ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চার প্রার্থীর লড়াই
পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি জেলা দার্জিলিং। আর জঙ্গলের জেলা ঝাড়গ্রাম। সাবেক পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ভেঙে ২০১৭ সালে গঠিত হয়েছিল এই পৃথক ঝাড়গ্রাম জেলা। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে এই ঝাড়গ্রাম জেলার অবস্থান। জেলাজুড়ে বনাঞ্চল। বড় বৈশিষ্ট্য, এই জেলা মাওবাদী–অধ্যুষিত। এখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, তফসিলি জাতি আর সাঁওতালি সম্প্রদায়ের বাস। ঝাড়গ্রাম জেলার একমাত্র লোকসভা আসন ঝাড়গ্রাম। এটি তফসিলিদের জন্য সংরক্ষিত। এই আসনে মূলত লড়াই করেন এই সম্প্রদায়ের প্রার্থীরাই। এবারও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি।
ঝাড়গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে কংসাবতী ও সুবর্ণরেখা নদী। এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক মন্দির, রাজবাড়ি। পশ্চিমবঙ্গের নামকরা পর্যটনকেন্দ্র ঝাড়গ্রাম। আছে ডিয়ার পার্ক, আদিবাসী জাদুঘর, ইকোপার্ক, ঐতিহাসিক সাবিত্রী ও কনক দুর্গামন্দির। ঐতিহাসিক কোকড়াঝাড় জঙ্গলও এখানে।
ঝাড়গ্রাম একসময় ছিল বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির দখলে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন ও তফসিলিদের এখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলে ঝাড়গ্রামের অবস্থান। মেদিনীপুরে ছিল তিনটি লোকসভার আসন। ঘাটাল, ঝাড়গ্রাম আর মেদিনীপুর। এই তিনটি আসনই ছিল বামপন্থীদের দখলে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রামে সাংসদ হয়েছিলেন সিপিএম নেতা পুলিন বিহারি বাস্কে, ঘাটালে হয়েছিলেন সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্ত আর মেদিনীপুরে হয়েছিলেন সিপিআইয়ের প্রবোধ পাণ্ড।
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় আসার পর জঙ্গল মহলের বামপন্থী দুর্গকে ভেঙেচুরে দেয়। ২০১৪ সালে এই তিনটি আসনই দখল করে তৃণমূল। এবার ২০১৯ সালে নির্বাচনী ময়দানে নেমেছে বামপন্থী দল সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি ও কংগ্রেস। এই চার দলই এবার ঝাড়গ্রাম আসনে প্রার্থী করেছে চার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও তফসিলি নেতাকে।
শাসক দল তৃণমূল প্রার্থী করেছে সাঁওতালি সম্প্রদায়ের নেত্রী ও স্কুলশিক্ষিকা বীরবাহা সরেন টুডুকে। তিনি এখন স্থানীয় রোহিণী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্বামী সাঁওতালিদের সামাজিক সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল’ কমিটির নেতা। তিনি এই প্রথম এলেন তৃণমূলের রাজনীতিতে। পেলেন টিকিট।
বাম দল সিপিএম প্রার্থী করেছে আরেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেত্রীকে। তিনি দেবলীনা হেমব্রম। তিনি সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য। তিনবার তিনি সিপিএমের টিকিটে রানিবাঁধ আসন থেকে বিধায়ক হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি সিপিএমের গড়া ‘আদিবাসী অধিকার রাষ্ট্রীয় মঞ্চের’ কেন্দ্রীয় কমিটিরও নেতা।
বিজেপি প্রার্থী করেছে প্রকৌশলী কুনার হেমব্রমকে। কুনার হেমব্রম বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলার সভাপতি। আর কংগ্রেস প্রার্থী করেছে যজ্ঞেশ্বর হেমব্রমকে। তিনি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী উমা সরেন বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। সিপিএমের প্রার্থী ও তৎকালীন সাংসদ পুলিন বিহারি বাস্কেকে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৮৮৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। এই পুলিন বিহারী পেয়েছিলেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৬২১ ভোট। বিজেপির বিকাশ মুদি পেয়েছিলেন ১ লাখ ২২ হাজার ৪৫৯ ভোট। আর কংগ্রেস প্রার্থী অনিতা হাঁসদা পেয়েছিলেন ৪০ হাজার ৫১৩ ভোট।
এবার এই ঝাড়গ্রাম আসনে লড়ছেন চার ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও তফসিল সম্প্রদায়ের প্রার্থী। এবার মূলত লড়াই হবে ত্রিমুখী। তৃণমূল, সিপিএম ও বিজেপি প্রার্থীর মধ্যেই।
সিপিএম প্রার্থী দেবলীনা হেমব্রম বলেছেন, গত বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের ভোটে অনেকটা ভাটার টান দেখা গেছে। এলাকাটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও তফসিলি উপজাতিদের সংরক্ষিত থাকলেও এটি দীর্ঘদিন ধরে সিপিএমের দখলে ছিল। এবার এই জঙ্গলমহলের মানুষ আবার এক হচ্ছে। তাঁরা বুঝেছে, এই জঙ্গল মহলে উন্নয়নের চাবিকাঠি বাম দল। তাই এবার মানুষ ঝুঁকছে সিপিএম প্রার্থীর দিকে।
সিপিএম প্রার্থী দেবলীনা আরও বলেছেন, ‘এবার আমরা জয় করব—এই প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছি। আমরা মনে করি, আমরা এবার উদ্ধার করতে পারব আমাদের এই আসনকে।’
সিপিএমের জেলা সভাপতি পুলিন বিহারী বাস্কে বলেছেন, ‘আমরা জিতব বলেই এবার প্রার্থী করেছি দেবলীনা হেমব্রমকে। আজ জঙ্গলমহলের মানুষ তৃণমূলের ওপর বিরক্ত। বিজেপিকে বিশ্বাস করে না। চাইছে ফের সিপিএমকে।’
তৃণমূল কংগ্রেসের ঝাড়খন্ড জেলা সভাপতি সুকুমার হাঁসদা বলেছেন, সিপিএমের অত্যাচারের কথা মানুষ ভোলেনি। তাই এবারও তারা ভোট দেবে তৃণমূলকে। মানুষ জানে মমতাই পারে এই জঙ্গলমহলের উন্নয়ন করতে।
বিজেপির জেলা সভাপতি কুনার হেমব্রম বলেছেন, এখানে তো সিপিএম ও তৃণমূল মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। তাদের দুর্নীতি আর অত্যাচারে কথা জঙ্গলমহলের মানুষ জানেন। তাই তো এবার মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূলও নয়, সিপিএমও নয়, তাঁরা ভোট দেবেন বিজেপিকে। তার ছবি তো গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ফুটে উঠেছে।
এই ঝাড়গ্রাম আসনের নির্বাচন হবে আগামী ১২ মে ষষ্ঠ দফায়।