কংগ্রেস সম্মেলন-সংস্কার সবই করছে, নেই শুধু মোদি ঠেকানোর দিশা
ভোটের রাজনীতিতে ধরাশায়ী কংগ্রেস। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দলের ভেতরে-বাইরে থেকে চাপ আছে। এরই মধ্যে ‘উদয়পুর নব সংকল্প ঘোষণায়’ দলে বড় ধরনের সংস্কার আনার পদক্ষেপ নিয়েছে দলটি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশটিতে ডানপন্থার বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে দিশা মেলেনি তিন দিনের এই সম্মেলনে।
ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ মেনে রাজনীতি করে আসা ভারতের কংগ্রেস উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। কিন্তু হিন্দুত্ববাদকে পুঁজি করে রাজনীতি করা ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাছে ভোটের রাজনীতিতে গত এক দশক ধরাশায়ী হয়েছে দলটি। এ জন্য ভারতে হিন্দুত্ববাদী মনোভাবের উত্থানের পাশাপাশি কংগ্রেসের নীতিগত ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকেও দায়ী করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে দলের ভেতরে-বাইরে থেকে চাপ আছে। এরই মধ্যে ‘উদয়পুর নব সংকল্প ঘোষণায়’ দলে বড় ধরনের সংস্কার আনার পদক্ষেপ নিয়েছে দলটি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশটিতে ডানপন্থার বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে দিশা মেলেনি তিন দিনের এই সম্মেলনে।
গত শুক্রবার রাজস্থানের উদয়পুরে কংগ্রেস শীর্ষ নেতাদের তিন দিনব্যাপী ‘চিন্তন শিবির’ শুরু হয়। সাংগঠনিক ভাঙনের কারণে সম্প্রতি এই রাজ্যের নির্বাচনেই আম আদমি পার্টির (আপ) কাছে দীর্ঘদিনের ঘাঁটি হাতছাড়া হয় কংগ্রেসের। তাই সম্মেলনের ভেন্যু নির্ধারণের আলাদা তাৎপর্য আছে বলাই যায়। এই সম্মেলনে সাংগঠনিক সংস্কারে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদিও কংগ্রেসের নেতৃত্ব গান্ধী পরিবারের হাতেই থাকছে। ২০২৪ সালে ভারতের পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে মোদি তথা বিজেপিকে ঠেকাতে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো কলাকৌশল সম্মেলনে ঠিক করতে পারেনি দলটি।
দলের কর্মপরিকল্পনা স্থির করাই এ ধরনের ‘চিন্তন শিবির’-এর মূল উদ্দেশ্য। খোলামেলা আলোচনার মধ্য দিয়ে এ ধরনের সম্মেলন থেকেই দলের পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারিতে প্রথম শিবিরে জোট রাজনীতির সাময়িক প্রাসঙ্গিকতা মেনে নিয়েছিল কংগ্রেস। ২০০৩ সালে হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলায় জাতীয় স্তরে ধর্মনিরপেক্ষ জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হয়েছিল। সেই সম্মেলনের পরের বছর লোকসভা নির্বাচনে জিতে কংগ্রেস জোট টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকে। অবশ্য ২০১৩ সালে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুরের ‘চিন্তন শিবির’ একেবারেই ফলদায়ী হয়নি। পরের বছর নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি শুধু ক্ষমতাই লাভ করেনি, কংগ্রেসকে নামিয়ে আনে তলানিতে। এবার উদয়পুরে শুরু গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা।
সাংগঠনিক সংস্কারে বড় সিদ্ধান্ত
নানামুখী চাপে থাকা কংগ্রেস সাংগঠনিক সংস্কারে সম্মেলনে বড় কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ‘এক পরিবার এক টিকিট’ সিদ্ধান্ত। এ নিয়ম চালু হওয়ায় এক পরিবারের একজনই ভোটে প্রার্থী হতে পারবেন। তবে পরিবারের দ্বিতীয় সদস্য পাঁচ বছর সক্রিয়ভাবে দলীয় রাজনীতিতে থাকলে ব্যতিক্রম বলে গণ্য হবে। ফলে কংগ্রেসের অন্তর্বর্তী সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর পাশাপাশি ২০১৯ সাল থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীরও নির্বাচনে লড়ার পথ খোলা থাকল। ‘একজনের এক পদ নীতিও’ গ্রহণ করা হয়েছে। একজন সর্বোচ্চ পাঁচ বছর একই পদে আসীন থাকতে পারবেন। যদিও কেউ একই পদে ফিরতে চান, তাহলে কমপক্ষে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আমাদের মানতে হবে জনগণের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক ভেঙে গেছে...আমাদের লড়াই আদর্শিক। জনগণের কাছে আমাদের যেতে হবে, তাদের পাশে বসতে হবেরাহুল গান্ধী, কংগ্রেস নেতা
ঘোষণায় ‘ফিফটি আন্ডার ফিফটি’ নীতি গ্রহণের কথা বলা হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কংগ্রেসের সর্বস্তরের কমিটিতে অর্ধেক সদস্য হবেন, যাঁদের বয়স ৫০ বছরের নিচে। প্রবীণের ভারে ন্যুব্জ দলটিতে গতি আনতেই এমন সিদ্ধান্ত বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া সব কমিটিতে সংখ্যালঘুসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতেই এমন পদক্ষেপ।
সম্মেলনের শেষ দিনে দেওয়া ভাষণে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, ‘আমাদের মানতে হবে জনগণের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক ভেঙে গেছে...আমাদের লড়াই আদর্শিক। জনগণের কাছে আমাদের যেতে হবে, তাদের পাশে বসতে হবে। জনগণের সঙ্গে দলের যে সম্পর্ক ছিল, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
দলীয় বিভিন্ন পদস্থ নেতাদের কাজের মূল্যায়নে একটি ‘মনিটরিং সেল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জনগণের মনোভাব নিশ্চিত হতে এবং নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য জরিপ পরিচালনায় একটি ‘জনমত পর্যবেক্ষণ বিভাগ’ করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সমন্বিত যোগাযোগ বিভাগ ও প্রশিক্ষণ বিভাগ চালুরও সিদ্ধান্ত হয়েছে সম্মেলনে। রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতি-কৌশল নির্ধারণে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে একটি কমিটি গঠন করে দেবেন দলের সভাপতি। যদিও অতীতে এ ধরনের কমিটিতে তেমন সুফল আসেনি।
সক্রিয় রাজনীতিতে থাকার একটা সর্বোচ্চ বয়সও বেঁধে দেওয়ার একটি উদ্যোগ ছিল তরুণ নেতৃত্বের। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি বিজেপিতে বয়স ৭৫ বছর বেঁধে দিয়েছিলেন। তবে জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরোধিতার মুখে কংগ্রেসে তা আলোর মুখ দেখেনি।
ফলে সম্মেলনের ঘোষণায় এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। সাংগঠনিক সংস্কারে ভারতের শীর্ষ রাজনৈতিক পরামর্শক প্রশান্ত কুমারের (পি কে) দেওয়া সুপারিশের কিছু ছাপ দেখা যায়। তবে শীর্ষ নেতৃত্ব গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে দেওয়া নিয়ে তাঁর সুপারিশ গ্রহণের কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। রাহুল নেতৃত্বে ফিরবেন কি ফিরবেন না, সে নিয়ে ধোঁয়াশায় আছেন ‘জি-২৩’ নামে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ ও ভিন্নমতাবলম্বী গ্রুপটিও।
মোদি ঠেকানোর দিশা নেই
সমাপনী বক্তব্যে সভাপতি সোনিয়া গান্ধী জানান, কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ নামে মার্চ করবে কংগ্রেস। বেকারত্বের মতো বিষয়গুলো এতে তুলে ধরা হবে। আগামী ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীজয়ন্তীতে এই কর্মসূচি শুরু হবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে নেওয়া ‘জনজাগরণ যাত্রার’ দ্বিতীয় ধাপ জেলা পর্যায়ে আগামী ১৫ জুন থেকে শুরু করা হবে বলেও জানান তিনি।
কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় নেওয়া সাংগঠনিক সংস্কারকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একমাত্র মুখ্য বিষয় নির্বাচনে জয়ী হওয়া এবং বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি ঠেকানোর কৌশল নির্ধারণে সম্মেলন আশাবাদী হওয়ার মতো বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
যতক্ষণ না এই দুটি বিষয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব নির্ভরযোগ্য কোনো কৌশল নির্ধারণ করতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত উদয়পুর ঘোষণা নিষ্প্রাণ ঘর গোছানোর পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হবে। বেশ কিছু ভুল এবং মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে না পারার কারণে পাঞ্জাব ও গোয়ার মতো রাজ্য হাতছাড়া করেছে কংগ্রেস।
কংগ্রেস সভাপতি ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তাঁরা ভালোভাবেই রাজনীতিতে আছেন এবং দলকে বলিষ্ঠতার সঙ্গে তাঁরা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। এমন সময় এসব কথাবার্তা হচ্ছে, যখন রাহুল গান্ধীকে নেপালে অবকাশ কাটাতে দেখা যায়। বিজেপির প্রচারযন্ত্র সেই ভিডিও ভাইরাল করে বলছে, তাঁর দল যখন নিজে থেকেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে, তিনি তখন অবকাশ যাপনে। রাহুল এখনো রাজনীতিকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে শেখেননি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁর জন্য দুই মেয়াদ যথেষ্ট নয়। এখন কংগ্রেস যদি আগামী নির্বাচন ‘রাহুল বনাম মোদি’ হিসেবে এগোতে চায়, তাহলে ইতিহাসকে হয়তো নিজেদের পক্ষে পাবে না। কারণ, বিগত পার্লামেন্ট নির্বাচনকে দৃশ্যত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরিণত করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনী প্রচারণায় দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। কার্যত বিজেপির প্রচারের মূলমন্ত্র ছিল এমন—প্রার্থী নয়, মোদিকে দেখে ভোট দিন।
আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে হলে জোটের রাজনীতি জোরদার করা ছাড়া বিকল্প নেই কংগ্রেসের সামনে। তবে এ হিসাবকে খুব কমই গুরুত্ব দিয়ে আসছেন রাহুল। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে, নির্বাচনে বাজে ফলের কারণে অন্যরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়তে আগ্রহী নয়। জোট গড়ার উদ্যোগের আগের অভিজ্ঞতাও সুখকর হয়নি। আসন বোঝাপড়া না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে আম আদমির সঙ্গে জোটের উদ্যোগ ভেঙে গিয়েছিল। তৃণমূলের সঙ্গে জোট গড়তে না পারায় গোয়ার নির্বাচনেও মাশুল গুনতে হয়েছিল কংগ্রেসকে। বহুজন সমাজবাদী পার্টির (বিএসপি) নেত্রী উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে তাঁর ডাকে সাড়া দেননি বলে রাহুল নিজেই স্বীকার করেছেন।
সংগঠন সংস্কারে পি কের পরামর্শ ছিল কাঠামোয় আমূল সংস্কার। আপাতত কংগ্রেস বাড়ির সদর দরজায় পরিবর্তন এনেই থামতে চাচ্ছে। তবে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক অবস্থান গ্রহণ ও নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়ের কোনো কৌশল আদৌ ঠিক করতে পারেনি কংগ্রেস। তাই তাদের সর্বশেষ সম্মেলন থেকে ঘর গোছানোর বাইরে রাজনৈতিক পরিবর্তনে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো কিছু অন্তত বিশ্লেষকেরা দেখছেন না।