অযোধ্যার পরে আর যা বাকি রইল বিজেপির
অযোধ্যা কাণ্ডের নিষ্পত্তি ঘটার পর এখন খুব সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, আর একটা কাজই বাকি রইল। অন্য ভাবে বলা যেতে পারে, রইল বাকি এক।
কেন এই কথা লিখলাম তার কারণ ভারতীয় জনতা পার্টি কিংবা তাদের আদর্শিক সংগঠন আরএসএস–এর সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র। আরএসএস ক্রমে ক্রমে তাদের রাজনৈতিক দল ‘বিজেপি’র জন্য নীতিমালা ঠিক করে দিয়েছে। যার মূল কথা, আমরা অন্যদের চেয়ে আলাদা। বিজেপিকে তাই বরাবর বলা হয় ‘পার্টি উইথ আ ডিফারেন্স।’
দলের রাজনৈতিক চরিত্র কেন অন্যদের থেকে আলাদা? সেই কবে থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা এইভাবে তার ব্যাখ্যা দিতেন। বলতেন, ‘আমরা আলাদা কারণ, আমরা কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা তুলে দিতে চাই, আমরা অয্যোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির গড়তে চাই এবং আমরা চাই সব ভারতবাসীর জন্য এক ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলন করতে। দেশের জন্য অন্য কোনো দলের এই কর্মসূচি নেই। এই কারণেই আমরা আলাদা।’
সাংবাদিকতা করতে দিল্লি গিয়েছিলাম সেই ১৯৮৪ সালে। সেই থেকে আর ঠাঁইনাড়া হইনি। দুই বছর পর ১৯৮৬ সালে ফৈজাবাদ জেলা আদালতের নির্দেশে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের বিতর্কিত কাঠামোর তালা খুলে দেওয়া হয়। সেই ঘটনা কভার করতে সেই প্রথম আমার অযোধ্যা যাত্রা। খুব অবাক হয়েছিলাম এটা জেনে যে যিনি মামলা করেছিলেন এবং যিনি রায় দিয়েছিলেন দুজনেই ছিলেন ব্রাহ্মণ। আইনজীবী উমেশ চাঁদ পাণ্ডে, জেলা শাসক কে এন পাণ্ডে। জেলা শাসক জানতে চেয়েছিলেন, রামলালার মন্দিরে তালা কেন লাগান আছে? পুলিশ সুপার জবাব দিয়েছিলেন, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। জেলা শাসক অবাক! তাঁর পরের প্রশ্ন, আপনি কি নিজেকে অযোগ্য মনে করেন? বিস্মিত পুলিশ সুপারের ভ্রু কুঁচকে ওঠে। জেলা শাসক তা দেখে বলেন, তার মানে তো দাঁড়ায় তালা খোলা হলে আপনি জেলাকে শান্ত রাখতে পারবেন না! সুপার নড়েচড়ে ওঠেন। বলেন, অবশ্যই পারব। আমার দক্ষতা একটা তালা নির্ভর নয়। জেলা শাসক পাণ্ডে কাল বিলম্ব না করে তালা খোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছিল মন্দির-মসজিদ বিতর্কের এক অন্যতম মাইল ফলক।
সেই থেকে অযোধ্যার কত ঘটনার সাক্ষী থেকেছি। এক একেক বার এক একটা ঘটনা ঘটেছে, বিজেপি নেতারা আশায় বুক বেঁধে বলেছেন, আরও একটা ধাপ এগোন গেল। এবার সব বাধা দূর করে দিলেন ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। বলে দিলেন, রাম মন্দির ওই বিতর্কিত স্থানেই। মসজিদের জন্য অন্য কোনো স্থানে ৫ একর জমি সরকারকে বন্দোবস্ত করে দিতে হবে।
যে তিনটি বিষয়ের জন্য বিজেপি দল হিসেবে অন্যদের থেকে আলাদা, সেগুলোর মধ্যে দুটো তাদের পাওয়া হয়ে গেল। নরেন্দ্র মোদীর পাগড়িতে ঝলমলে পালক হয়ে তা শোভা পাচ্ছে। এক জীবনে (জীবন অর্থে প্রধানমন্ত্রিত্ব) এতখানি প্রাপ্তি আর কারও ভাগ্যে কি হয়েছে? অন্তত তাঁর দলে? নির্দ্বিধায় বলা যায়, নাহ, কারও ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন ছিল না। অটল বিহারি বাজপেয়ি তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনটির একটিও আদায় করতে পারেননি। অথচ মোদী? পরপর দুবার শুধু একার জোরে ক্ষমতা দখল নয়, আসমুদ্র হিমাচল দলের বিস্তৃতি নয়, তিন স্বপ্নের দুটি সাকার করে তুললেন! সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার কেড়ে রাজ্যটাকে অন্যদের মতো সাধারণ করে তুললেন। তারপর সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে আদায় করে নিলেন অযোধ্যার দাবি। বাকি থাকল শুধু সারা দেশের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন। ওই লক্ষ্যে তাঁর সরকার এক কদম এগিয়েও রয়েছে তিন তালাক নিষিদ্ধ আইন পাস করিয়ে। বাকিটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
মূল জিনিসের সঙ্গে ফাউ চাওয়া আমাদের জন্মগত অধিকার। ৩৭০ ও অযোধ্যার পাশাপাশি ফাউ কি ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা পাননি? অবশ্যই সেই প্রাপ্তিও ঘটেছে এই মোদী জমানায়। সবচেয়ে বড় পাওনা এনআরসি। আরও একটা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি তিনি ও তাঁর দল শুনিয়ে রেখেছে। পড়শি দেশের অমুসলিম অত্যাচারিতদের ভারতীয় নাগরিক করে তোলা। বিজয় রথের চাকা যেভাবে গড়গড় করে গড়াচ্ছে, তাতে কে বলতে পারে, ২০২৪–এর মধ্যে ষোলো কলা পূর্ণ হবে না?
সুপ্রিম কোর্টের অযোধ্যা রায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফৌজদারি মামলা ছোঁয়নি। ফলে বিজেপির সেই যুগের নেতাদের আদৌ শাস্তি পেতে হবে কিনা জানা যাচ্ছে না। অবশ্য কীই বা শাস্তি হবে? হলেও কবেই বা তা কবে হবে? এখন এই সব অলক্ষুনে প্রশ্ন তোলার কোনো মানেও হয় না। কেননা, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের আগে সেই মামলার নিষ্পত্তিতে আগ্রহ দেখাবেন বলে কোনো ইঙ্গিত এখনো দেননি। তবে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ–এর নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যর সাংবিধানিক বেঞ্চ রাম মন্দির স্থাপনের জন্য যে যুক্তিজাল বিছিয়েছেন, তা হিন্দুত্ববাদীদের পালে বাড়তি বাতাস দিতে পারে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের দেওয়া নিদর্শন যদি অযোধ্যা সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে কাশীর জ্ঞানব্যাপী ও মথুরার শ্রী কৃষ্ণ জন্মস্থান ‘উদ্ধারও’ তো অসম্ভব নয়? তিন মন্দিরের সমস্যা তো হুবহু এক! তিনটির ‘মুক্তি’র দাবি তো সেই আদ্যিকালের!
বাড়তি এই সব বিষয় আপাতত থাক। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত নীতিতে এগুলো নেই। ইশতেহার মেলালে বরং অধরা বলতে শুধুই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। মানে, রইল বাকি এক। সেটুকু সাকার হলে সেই বহু চেনা স্লোগানটা গমগম করে উঠবে, ‘হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্তান’।