সীতারাম ইয়েচুরি: মেধাবী মুখ থেকে হয়ে ওঠেন ভারতে ‘বাম রাজনীতির আলোকবর্তিকা’

সিপিআই (এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিছবি: এএনআই

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিস্ট)–সিপিআই (এম) এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আর নেই। শ্বাসযন্ত্রে গুরুতর সংক্রমণ নিয়ে গত ২৫ দিন তিনি দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসে (এইমস) চিকিৎসাধীন ছিলেন। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সিপিআই (এম)–এর ৭২ বছর বয়সী এই উদারপন্থী মুখ।

সীতারাম ইয়েচুরির ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মরদেহ ডাক্তারি শিক্ষা ও গবেষণার জন্য এইমস কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

কিছুদিন ধরেই সীতারাম ইয়েচুরির শরীর ভালো যাচ্ছিল না। শ্বাসযন্ত্রে সমস্যা ছিল। সেই সঙ্গে চোখের সমস্যাও ছিল। এদিক থেকে তাঁর সঙ্গে অদ্ভুত মিল ছিল পশ্চিমবঙ্গের সদ্য প্রয়াত সিপিআই (এম)–এর মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দুজনেরই ছিল শ্বাসযন্ত্র ও চোখের সমস্যা। আগস্টের ৮ তারিখ তাঁর চোখের ছানি অপারেশনের দিনেই কলকাতায় মারা যান বুদ্ধদেব। তার কয়েক দিনের মধ্যেই ফুসফুসে সংক্রমণ নিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি ভর্তি হন এইমসে। তিন সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবার সেই হাসপাতালের আইসিইউ থেকে বের হলো সিপিআই (এম)–এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে ‘বেঙ্গল লাইনের’ সবচেয়ে বড় সমর্থকের নশ্বর দেহ।

সিপিআই (এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি
ছবি: এএনআই

সীতারামের মৃত্যুতে সিপিআই (এম) তো বটেই ভারতের জাতীয় রাজনীতিতেও সৃষ্টি হলো এক গভীর শূন্যতা। দলীয় রাজনীতিতে প্রকাশ কারাত বরাবর বিবেচিত হতেন ‘কট্টরপন্থী’ বলে, সীতারাম ‘নরমপন্থী’ বিপ্লবী নেতা। কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভাজনের সময় থেকে কংগ্রেস বিরোধিতা ছিল সিপিআই (এম)–এর বরাবরের রাজনৈতিক লাইন; কিন্তু যেদিন থেকে বিজেপি না কংগ্রেস কে বড় শত্রু সেই বিতর্ক মাথাচাড়া দিল, সীতারাম তখন থেকেই বিজেপিকে বড় শত্রু ভেবে কংগ্রেসের সঙ্গে থাকার পক্ষে মত দেন। মনমোহন সিং সরকারের দ্বিতীয় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে প্রকাশ কারাতের নেতৃত্বে সিপিআই (এম) যখন সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়, সীতারাম তখন তার বিরোধিতা করেছিলেন। সিপিআই (এম)–এর ‘বেঙ্গল লাইনের’ সমর্থক ছিলেন বলে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে তিনি আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীকালে ঘরোয়া আলাপচারিতায় স্বীকারও করেছেন, সেদিন দল জ্যোতি বসুর পাশে দাঁড়ালে দেশের রাজনীতি অন্য খাতে বইতেও পারত। লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও তিনি করেছিলেন। পরে দল ভুল বুঝতে পেরে তাঁকে ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও সোমনাথ রাজি হননি। সীতারাম অনেক চেষ্টা করেও সফল হননি।

কিন্তু বিজেপির মোকাবিলায় ‘ইন্ডিয়া’ জোট গড়ে তুলতে এবং জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকতে সীতারাম ইয়েচুরি বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন। ইন্ডিয়া জোটের আগেও তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল জোট গঠনের অনুঘটক। ইউপিএ সরকার গড়ার সময় অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরিতে কংগ্রেসের প্রণব মুখোপাধ্যায়, পি চিদাম্বরমের সঙ্গে তিনি যেমন হাত মিলিয়েছিলেন, তেমনই ইন্ডিয়া জোট গঠনেও তিনি ছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গী। ক্রমেই সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীর সঙ্গে তাঁর এক চমৎকার সখ্য গড়ে উঠেছিল। একে অন্যের হয়ে উঠেছিলেন ভরসার জায়গা। তা নিয়ে দলে সীতারামকে যেমন জবাবদিহি করতে হয়েছে, তেমনই কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বকেও শুনতে হয়েছে—সীতারাম নীতিনির্ধারণে তাঁদের প্রভাবিত করছেন; কিন্তু দুই দলের নেতাদের সেই সখ্য ও বিশ্বাসে চিড় ধরেনি।

তেলুগুভাষী সীতারামের জন্ম মাদ্রাজে (আজকের চেন্নাই) ১৯৫২ সালের আগস্টে। সেখান থেকে দিল্লি এসে মেধাবী সীতারাম দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ভারতের মধ্যে প্রথম হন। অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। তার পর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)। সেখানে পড়ার সময়েই বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। সিপিআই (এম) এর ছাত্র সংগঠন দিয়ে শুরু, শেষ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদাধিকারী হিসেবে।

বামপন্থী নারী আন্দোলন নেত্রী বীণা মজুমদারের কন্যা ইন্দ্রাণী ছিলেন সীতারামের প্রথম স্ত্রী। তাঁদের দুই সন্তান। পুত্র আশিস, কন্যা অখিলা। ২০২১ সালে কোভিডকালে আশিসের মৃত্যু হয়। অখিলা যুক্তরাজ্যের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সীতারাম বিয়ে করেন সাংবাদিক সীমা চিস্তিকে।

সীতারামের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, সড়কমন্ত্রী নিতিন গড়কড়িসহ বিভিন্ন দলের নেতারা। গভীর শোকপ্রকাশ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দলগতভাবে কংগ্রেস এবং দলের নেতা রাহুল গান্ধী শোক প্রকাশ করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এ রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘সীতারাম ইয়েচুরি ছিলেন আমার বন্ধু। দেশ হিসেবে ভারত সম্পর্কে গভীর বোঝাপড়া ছিল তাঁর। ভারতের আদর্শ রক্ষায় ছিলেন সদা সচেষ্ট। আমাদের মধ্যে নানা সময়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো। বড্ড অভাব বোধ করব সেসবের।’

সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এক বিবৃতিতে সিপিবির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, তাঁর মৃত্যুতে দক্ষিণ এশিয়ার শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষ মানবমুক্তি তথা সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের এক বিপ্লবী নেতাকে হারালেন।

বিবৃতিতে সিপিবি নেতারা আরও বলেন, বাংলাদেশ তথা এদেশের মেহনতি জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন, দক্ষিণ এশিয়ার সাম্যবাদী আন্দোলন ও ভারতের বামপন্থী আন্দোলনে তাঁর অবদান ভাস্কর হয়ে থাকবে।