ভারতে মসজিদ–মন্দির ঘিরে উত্তেজনার জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতিকে দায়ী করছেন রাজনীতিকেরা

ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ছবি: এএনআই

ভারতে মসজিদ–মন্দির ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক। সেই বিতর্কে জড়িয়ে গেছে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নাম। দেশে নতুন করে মসজিদ–মন্দির বিতর্কে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য সরাসরি দায়ী করা হচ্ছে তাঁকে।

মসজিদ বা দরগাহর নিচে মন্দির থাকার ‘নিদর্শন’ খুঁজতে সমীক্ষা বা জরিপের অনুমতিদান এবং সে কারণে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য চন্দ্রচূড়কে দায়ী করে বলা হচ্ছে, তিনিই ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে দিয়েছেন। বারানসিতে মন্দির ভেঙে জ্ঞানবাপি মসজিদ তৈরি হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে এলাহাবাদ হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, ১৯৯১ সালে তৈরি ধর্মস্থান আইনের নিরিখে প্রধান বিচারপতি হিসেবে চন্দ্রচূড় তা খারিজ করে দিতে পারতেন। অথচ তা তিনি তো করেনইনি, বরং আস্থার যুক্তি দেখিয়ে সেখানে তিনি পূজার্চনারও ছাড়পত্র দিয়েছিলেন।

‘প্যান্ডোরার বাক্স’ যা কি না অশেষ দুর্গতির উৎস, সে জন্য সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রথম দায়ী করেন আজমির শরিফ দরগাহর রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থার সম্পাদক সৈয়দ সারোয়ার চিশতি। নিম্ন আদালত ওই দরগাহর নিচে মন্দিরের খোঁজ করতে সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়ার আবেদন গ্রাহ্য করার পর গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি থাকাকালে ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় উদ্যোগী হলে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটত না। দুঃখের বিষয়, সেই উদ্যোগ তিনি নেননি।

সারোয়ার চিশতির মন্তব্যের পর গত শনিবার কংগ্রেস নেতা ও সংসদ সদস্য জয়রাম রমেশ ‘এক্স’ হ্যান্ডলে লেখেন, ২০২২ সালের ২০ মে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে।

চন্দ্রচূড়ের সেই পর্যবেক্ষণ আজ প্রবলভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ অযোধ্যা মামলার রায় দিয়েছিলেন, যে রায়ে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, চন্দ্রচূড় ছিলেন সেই বেঞ্চের অন্যতম বিচারপতি।

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের সম্ভলে ধর্মীয় সহিংসতার পর মসজিদে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ২৫ নভেম্বর
ছবি: এএফপি

রায় দেওয়ার সময় ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইনের উল্লেখও করা হয়েছিল, যে আইনে বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির দিন দেশের সব ধর্মস্থানের চরিত্র যেমন ছিল, তেমনই রাখতে হবে। একমাত্র ব্যতিক্রম অযোধ্যা, যা ছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সেই আইন পাস করার সময় লোকসভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চহ্বন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষার গুরুত্ব নিয়ে যা বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সে কথারও উল্লেখ করা হয়েছিল।

অথচ জ্ঞানবাপি মসজিদে জরিপের নির্দেশের বিরোধিতা করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে গেলে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানিয়েছিলেন, ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী উপাসনালয়ের চরিত্র বদল করা যাবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে চরিত্র নির্ধারণ করা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আশিস গোয়েল ‘এক্স’ মারফত বলেছেন, জ্ঞানবাপি নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতির অবস্থানই উত্তর প্রদেশের সম্ভলে পাঁচজনের প্রাণ নিয়েছে। এটা অন্যভাবে দেখার আর কোনো সুযোগ নেই। নিম্ন আদালতের নির্দেশে সম্ভলের জামা মসজিদে জরিপ করতে গেলে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন।

সম্ভল ও আজমির শরিফ বিতর্ক শুরু হওয়ার পর চন্দ্রচূড়ের মতোই আলোচনায় উঠে এসেছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত। জ্ঞানবাপি বিতর্ক শুরু হওয়ার পর ২০২২ সালে মোহন ভাগবত বলেছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপন। সেই লক্ষ্য পূরণ হতে চলেছে। প্রতিটি মসজিদের তলায় শিবলিঙ্গ খোঁজার কোনো প্রয়োজন নেই।’

জয়রাম রমেশ ‘এক্স’ বার্তায় চন্দ্রচূড়ের সমালোচনা করার পর কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও সরব হয়েছেন। গতকাল রোববার দিল্লিতে এক জনসভায় তিনি বলেন, বিজেপির বিভাজন নীতি দেশের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জন্য দায়ী। তাদের উদ্যোগেই আজ জায়গায় জায়গায় মসজিদ–দরগাহর নিচে মন্দির খোঁজার হিড়িক শুরু হয়েছে।

মল্লিকার্জুন বলেন, বিজেপির উচিত, সংঘ প্রধান মোহন ভাগবতের মন্তব্য মেনে চলা। শাসক দলকে তিনি ১৯৯১ সালের ধর্মস্থান আইনের কথাও মনে করিয়ে দিয়ে জানতে চান, হিন্দু মন্দির ও স্থাপনা উদ্ধারে বিজেপি কি লালকেল্লা, তাজমহল, কুতুব মিনার, চার মিনারের (হায়দরাবাদ) মতো স্থাপত্য ধ্বংস করতে চায়?

ভারতের রাজস্থানের আজমির শরিফে ভক্তদের ভিড়
ফাইল ছবি-এএনআই

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারত–বাংলাদেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই বলে অভিযোগ তুলেছেন মেহবুবা মুফতি। জম্মুতে গত রোববার তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের দুর্দশার কথা খুব শোনা যাচ্ছে। সে নিয়ে এ দেশে হইচই চলছে। কিন্তু আমাদের এই বিশাল ধর্মনিরপেক্ষ দেশের অবস্থাটা কেমন? এখানেও তো সংখ্যালঘুদের একই রকম হাল! ওখানে মন্দিরে হামলা হচ্ছে, এখানে মসজিদে। সর্বত্র শিবলিঙ্গ খোঁজা হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি হিন্দুদের জেলে পোরা হয়ে থাকে, এখানেও তেমনই মুসলমানদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে। কোনো পার্থক্য নেই।’

মুফতি বলেন, কোনো সন্দেহ নেই, ভারতের অধিকাংশ হিন্দুই ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁদের জেগে উঠতে হবে। একের সঙ্গে অন্যের বিরোধ বাঁধানো হচ্ছে। এভাবে দেশটাকে আরও একবার ১৯৪৭ সালের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

উত্তর প্রদেশের সম্ভল সংঘর্ষের উল্লেখ করে মেহবুবা মুফতি বলেন, মানুষকে মেরা ফেলা হচ্ছে অথচ কিছু বলার উপায় নেই। মুখ খুললেই জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে।

রাজস্থানের আজমির শরিফ প্রসঙ্গে মেহবুবা বলেন, ‘৮০০ বছর ধরে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, শিখ—সব ধর্মের মানুষ সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক এই দরগাহতে আসছেন। মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করছেন। এ দেশের গঙ্গা–যমুনা সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে আছে এই আজমির শরিফ। আজ তা দখলের চেষ্টা শুরু হয়েছে। এভাবে দেশ কোন দিকে যাচ্ছে বুঝি না।’