বিজেপি সরকার দাবি কতটা মানবে, সন্দিহান কৃষকেরা

‘দিল্লি চলো’ কৃষক আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজপুরায় কৃষকদের অবস্থান। ১৬ ফেব্রুয়ারিছবি: এএনআই

ভারতে কৃষকনেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের তিনটি বৈঠকেও সমাধান সূত্র বের হয়নি। আগামীকাল রোববার চতুর্থ দফার বৈঠকও অমীমাংসিত থাকলে ‘দিল্লি চলো’ অভিযানের ভবিষ্যৎ কী হবে, কৃষকনেতাদের তা ভাবাচ্ছে। অধিকাংশ কৃষকনেতা মনে করছেন, কেন্দ্রীয় সরকার আলোচনার নামে অযথা কালক্ষেপণ করে কৃষকদের পাঞ্জাব–হরিয়ানা সীমান্তে আটকে রাখতে চাইছে।

কৃষকনেতাদের ধারণা, এত দিন ধরে যে দাবি মানতে সরকার রাজি হয়নি, এখন তা মেনে নেবে মনে করার তেমন কোনো কারণ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা সরকারকে আরও কিছুদিন সময় দিতে চাইছেন, যাতে আন্দোলনের যাবতীয় দায় সরকার তাঁদের ওপর ফেলতে না পারে।

আজ শনিবার ছিল এই পর্যায়ের কৃষক আন্দোলনের পঞ্চম দিন। এই পাঁচ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে তিনটি বৈঠক করেছে। প্রথম বৈঠকটি হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। পরের দুটি যথাক্রমে ১২ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি। তিনটি বৈঠকই অমীমাংসিত। কৃষকেরা এমএসপির আইনি বৈধতার প্রশ্নে কোনো সমঝোতায় রাজি নন, সরকারও ওই দাবি মানতে নারাজ। এই পরিস্থিতিতে জট কীভাবে খুলতে পারে, কোনো মহলেই সেই ধারণা নেই।

গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তৃতীয় বৈঠক থেকে বের হয়ে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডা, বাণিজ্য ও উপভোক্তামন্ত্রী পীযুষ গয়াল ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, খুবই অনুকূল পরিবেশে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনার রেশ ধরে রোববার চতুর্থ দফার বৈঠক বসবে।

রোববারের বৈঠকের আগে কৃষকনেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছিলেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত সিং মান ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হরপাল সিং চিমা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে কৃষকদের বৈঠকেও তাঁরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর তাঁদের দাবি ছিল, অনেক বিষয়েই দুই পক্ষ সহমত। কিন্তু আসল সমস্যা, যা কিনা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনি বৈধতা, সে বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যবধান ঘোচেনি।

এমএসপি নিয়ে কৃষকদের মনোভাব আরও দৃঢ় হয়েছে কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতিতে। ক্ষমতায় এলে এমএসপির আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হবে বলে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর ঘোষণা কৃষকদের অবস্থান যেমন জোরালো করেছে, তেমনই ভোটের মুখে কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে সরকারকে।

সরকারের পক্ষে অস্বস্তি আরও বাড়িয়েছেন ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত কৃষিবিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথনের কন্যা অর্থনীতিবিদ মধুরা স্বামীনাথন কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোয়। কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, ‘বাবাকে যদি সত্যিই সম্মানিত করতে হয়, তাহলে কৃষকদের সঙ্গে নিয়েই করতে হবে।’

কৃষকদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়া, ড্রোনে নজরদারি চালানো, লাঠিপেটা, জবরদস্তি করে আটকানোয় ক্ষুব্ধ মধুরার প্রশ্ন, ‘কৃষকেরা কি সমাজবিরোধী? তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ কেন করা হচ্ছে? তাঁরা দেশের অন্নদাতা। অন্নদাতাদের ওপর জোর খাটালে সমস্যা মিটবে না। সমাধানের জন্য আলোচনা দরকার।’

সরকারি সূত্রের খবর, কৃষকদের সঙ্গে আলোচনায় মোট ১৩টি দাবি বিবেচিত হচ্ছে। এসব দাবির মধ্যে প্রধান হলো এমএসপি। সরকারের দাবি, ১০টি দাবি মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই।

এমএসপির আইনি স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে সরকার এখনো অনড়। এই মানসিকতার একটি কারণ, এবারের কৃষক আন্দোলনের ব্যাপকতা ২০২০–২১ সালের মতো নয়। দেশে ২০০টির বেশি সংগঠন এবারের আন্দোলনে যোগ দিলেও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের বৃহত্তম সংগঠন ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন এই অভিযানে শামিল হয়নি।

কেন্দ্রীয় সরকার মনে করছে, ফলে এবারের আন্দোলনের তীব্রতা আগেরবারের মতো নয়। দিন দিন তার ধার ও ভার কমে যাবে। লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হলে নেতাদের পক্ষে আন্দোলন ধরে রাখাও কঠিন হবে। সরকার তাই আলোচনার মধ্য দিয়ে আরও সময় নিতে চাইছে।

প্রশ্ন হলো, সেই সময় কৃষকনেতারা কতটা দেবেন। ইতিমধ্যেই শম্ভু সীমান্তে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। সরকারের দাবি, বৃদ্ধ ওই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে হৃদ্‌রোগে। এই আন্দোলনের রেশ অন্য রাজ্যেও ছড়াচ্ছে। মৃত্যু হয়েছে এক পুলিশ কর্তারও। সরকারের কাছে এই প্রাণহানি খুবই অস্বস্তির।

অস্বস্তির খবর এসেছে বিজেপি–শাসিত রাজ্য ত্রিপুরা থেকেও। সেই রাজ্যে বামপন্থী কৃষক সংগঠনগুলো বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকনেতা সারওয়ান সিং পান্ধের বলেছেন, সরকারের উচিত এমএসপি নিয়ে অবিলম্বে অর্ডিন্যান্স জারি করা। তাঁর মতে, এই মুহূর্তে এটাই একমাত্র উপায়।

কৃষকদের আন্দোলন অর্থনীতির ওপরেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। পাঞ্জাব হরিয়ানা দিল্লি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (পিএইচডিসিসিআই) সভাপতি সঞ্জীব আগরওয়াল জানিয়েছেন, আন্দোলন অব্যাহত থাকলে দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির দৈনিক লোকসান হবে ৫০০ কোটি রুপি। সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকার ও কৃষকদের দেশের অর্থনীতির স্বার্থে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটানোর অনুরোধ করা হয়েছে।

এই আন্দোলনের দরুন খাদ্য ও পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। দিল্লির সব বাজারে সবজি, ফলসহ সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে।