হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ বানিয়ে পানির সমস্যা মেটাচ্ছেন লাদাখের ‘বরফমানব’
হিমালয় পর্বত এলাকায় একসময় অনেক তুষার পড়ত। বর্তমানে সেখানে বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না বললেই চলে। চারদিকে শুধু জমাট বাঁধা বরফ আর বরফ। আগে যে এলাকায় ব্যাপক চাষাবাদ হতো, এখন সেচের অভাবে আর চাষাবাদ হয় না। এই পরিস্থিতিতে ফসলের খেতে সেচের পানি সরবরাহের জন্য হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করছেন একজন স্থানীয় উদ্ভাবক।
চেওয়াং নরফেল নামের ওই প্রকৌশলী লাদাখের গ্রামে সফলভাবে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেছেন। এ কারণে তাঁকে ‘লাদাখের বরফমানব’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই কৃতিত্বের জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য স্বীকৃতি ও সম্মাননা।
লাদাখের থিকসি গ্রামের ৫৮ বছর বয়সী আলুচাষি দোলকর বলেন, ‘আমার মনে আছে, এখানে ছোটবেলায় আমার হাঁটুর সমান তুষার পড়ত। কিন্তু এখন বৃষ্টি বা তুষারপাত আর হয় না।’
দোলকরের পূর্বপুরুষেরাও আলুচাষি ছিলেন। তবে বছরের পর বছর ধরে তিনি পারিবারিক আয় কমে যেতে দেখেছেন। লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে ১৯ কিলোমিটার পূর্বে তাঁর শহরটি ঘিরে আছে বরফে।
দোলকর বলেন, ‘আলুচাষি হিসেবে আমরা প্রতি মাসে ৭০ হাজার রুপি আয় করতাম। কিন্তু এখন তা কমে ২০ হাজার রুপি আয় হয়।’
পতনশীল হিমবাহ
হিমালয়ের এ অঞ্চলে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জায়গাজুড়ে ৫৫ হাজার হিমবাহ আছে, যা মেরু ক্যাপের বাইরের বৃহত্তম বরফের প্রতিনিধিত্ব করে। মেরু ক্যাপ হলো উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে পাওয়া বরফের গম্বুজ আকৃতির শিট। এ অঞ্চলগুলো পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সূর্য থেকে কম তাপ পায়। তবে বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এই ভঙ্গুর হিমালয় বাস্তুতন্ত্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশকে প্রভাবিত করবে।
হিমালয়ের এক-তৃতীয়াংশ হিমবাহ পরের শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, যা এশিয়ার নদীব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে। এই নদীব্যবস্থা থেকে প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের পানি সরবরাহ হয়ে থাকে। এই গলিত হিমবাহের কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং প্রায় ১২ কোটি ৯০ লাখ কৃষকের জীবন-জীবিকা ব্যাহত হবে। লাদাখে দোলকরের যেখানে বাড়ি, সেই এলাকায় এই হুমকির মুখে আছে।
লাদাখের এই এলাকা ঠান্ডা ও জলবায়ু শুষ্ক। এখানে বার্ষিক প্রায় ৮৬ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ কৃষক তাঁদের ফসলের খেতে সেচের জন্য হিমবাহের ওপর নির্ভর করে। তবে গত ৩০ বছরে তুষারপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এতে তুষার আচ্ছাদন কমেছে। এ কারণে হিমালয় এলাকার গ্রামগুলোতে হিমবাহ, অপর্যাপ্ত স্রোত এবং পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
দোলকরের গ্রামে চেওয়াং নরফেল একটি উদ্ভাবনী কৌশল ব্যবহার করে এই হিমবাহ সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। নরফেল থিকসির পাশের গ্রাম নাংয়ে সফলভাবে একটি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেছেন। এ কারণে তাঁকে ‘লাদাখের বরফমানব’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সেচ সমস্যার সমাধানে ৮৭ বছর বয়সী নরফেল বিভিন্ন গ্রামে পরিদর্শন করেছেন। তিনি দেখেন, ৮০ শতাংশ কৃষক পানির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। হিমবাহ গলিত পানি কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পানি শুধু জুনের মাঝামাঝি প্রবাহিত হয়। এ কারণে কৃষিসম্পদ সংরক্ষণে নরফেল একটি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে তিনি নাংসহ লাদাখ অঞ্চলের আরও ১০টি গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেন।
নাং গ্রামটি লাদাখ অঞ্চলের লেহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৭৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এই গ্রামের ৩৩৪ লোকের বসবাস। এখানকার প্রাথমিক জীবিকা হলো কৃষি, যার প্রধান ফসল আলু ও গম। নাংয়ে স্থায়ী হিমবাহ নেই। প্রাকৃতিক ঝরনা থেকে এখানে পানি সরবরাহ করা হয়। চাষাবাদের মৌসুম এপ্রিল ও মে মাসে কৃষকদের চাহিদা মেটাতে এখানে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না।
নরফেল বলেন, ‘প্রধান হিমবাহ শুধু জুন মাসেই পানি দিতে শুরু করে। আমরা যেহেতু পানি তৈরি করতে পারি না, তাই আমাদের একমাত্র বিকল্প উপলব্ধ উৎস ব্যবহার করা।’
নরফেল আরও বলেন, তাঁর বাড়ির পেছনে বাগানের কল শীতকালে বাগানে সেচ দিতে চালু রাখা হয়। বিষয়টি দেখে তিনি হিমবাহের পানিকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহারের ধারণা পেয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যদি নষ্ট পানি ধরে রাখতে এবং জমাটবদ্ধ করতে পারেন, তবে তিনি পুরো গ্রামের জন্য একটি কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করতে পারবেন।
নরফেল কৌশলগতভাবে বিভিন্ন উচ্চতায় একাধিক হিমবাহ তৈরি করেছেন। গ্রামের সবচেয়ে কাছের হিমবাহ, সর্বনিম্ন উচ্চতায় অবস্থিত। এটি প্রথমে গলে গিয়ে বসন্তে প্রাথমিক বপনের সময় প্রয়োজনীয় সেচের পানি সরবরাহ করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অতি উচ্চতায় পরবর্তী হিমবাহ গলতে শুরু করে, যা নিচের দিকের জমিতে সময়মতো সেচের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করে।
বরফপ্রাচীর কৌশল
কৃত্রিম হিমবাহসহ জল ব্যবস্থাপনা সমাধান প্রদানকারী সংস্থা অ্যাকরস অব আইসের সহপ্রতিষ্ঠাতা সূর্যনারায়ণ বালাসুব্রামানিয়ান। তিনি সুইজারল্যান্ডের ফ্রিবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বরফের জলাধারের ওপর পিএইচডি করছেন। বর্তমানে বরফের হিমবাহ কীভাবে পানি সংরক্ষণ বৃদ্ধি করতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন।
সূর্যনারায়ণ বলেন, ‘নাং গ্রামের উপত্যকাজুড়ে পাহাড়ের ওপর থেকে একটি হিমায়িত খাল আছে। এই খাল বরাবর কৌশলগতভাবে স্থাপিত শিলা দেয়ালগুলো জলের গতিকে ভেঙে দিয়ে হিমাঙ্কের সম্ভাবনা বাড়ায়। শিলা দেয়ালের উদ্দেশ্য হলো হিমাঙ্কের হার বৃদ্ধি করা, যার ফলে উপত্যকাজুড়ে বরফের চাদর তৈরি হয়। এই উদ্ভাবনী পদ্ধতি সফল হয়েছে। এতে গ্রামের পানি সরবরাহ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।’
নরফেল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এই হিমবাহ থেকে এপ্রিলে পানি সরবরাহ হওয়ায় প্রায় ১০টি গ্রাম উপকৃত হচ্ছে। আমরা আরও দুটি হিমবাহ নির্মাণ করছি। এটি ভূগর্ভস্থ জল ধরে রাখতে খুব ভালো একটি সমাধান, যা লাদাখে অতিরিক্ত পর্যটনের কারণে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।’
নাং গ্রামের কৃষকেরাও এই হিমবাহের জন্য কৃতজ্ঞ। ৪৪ বছর বয়সী কৃষক রিগজেন ওয়াঙ্গাল বলেন, ‘কৃত্রিম হিমবাহের আগে আমাদের পর্যাপ্ত পানি পাওয়া কঠিন ছিল। যদিও প্রচুর তুষারপাত ছিল, কিন্তু তা অনেক দূরে ছিল। সেগুলো গলে আমাদের কাছাকাছি আসতে অনেক সময় লাগত। এ কারণে ফসল কাটতে দেরি হতো এবং কখনো কখনো আমাদের খামারগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছিল। এখন পর্যাপ্ত পানি আছে।’
১৯৯৫ সালে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির জন্য একটি অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে কাজ শুরু করেন নরফেল। হিমবাহ তৈরির জন্য ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ভারতের অন্যতম বড় বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী পেয়েছেন। তাঁর এই উদ্ভাবনী ধারণা অন্যান্য প্রকল্পের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। যেমন লাদাখে সোনম ওয়াংচুকের বরফ স্তূপ। যেখানে হিমায়িত জল গলানোর আগে স্তূপের আকার ধারণ করে এবং চাষের মৌসুমে পানি বিতরণ করা হয়।
বৈশ্বিক সমস্যার স্থানীয় সমাধান
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম হিমবাহ একটি শক্তিশালী পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কৌশল। যদিও বৈশ্বিক হিমবাহ গলানোর সমস্যার সমাধান তাঁদের কাছে নেই। তবু তাঁরা বিশ্বব্যাপী অসংখ্য সম্প্রদায়ের চ্যালেঞ্জকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারে, যা হিমবাহের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডেভিড রাউন্স সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে বলেছেন, বিশ্বের হিমবাহের ভর ২১ শতকের শেষ দিকে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ হারানোর ঝুঁকি আছে।
ডেভিড রাউন্স বলেন, ‘এটি অত্যন্ত চতুর একটি ধারণা। এই অঞ্চলে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন বরফের স্তূপ এবং হিমবাহ তা ভালোই কাজ করে বলে মনে হচ্ছে। তাঁরা অনেক পানি সঞ্চয় করতে পারে, উঁচু পাহাড়ি সম্প্রদায়ের জন্য মূল্যবান সুপেয় পানি সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু যখন আমরা সমস্যাটির কথা চিন্তা করি, তখন বৈশ্বিক সমাজ হিসেবে আমরা এ নিয়ে পদক্ষেপ না নিলে তাপমাত্রা কেবল বাড়তেই থাকবে।’
নেপালের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি) হিমালয়ের জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে কাজ করা একটি আন্তসরকারি সংস্থা। সংস্থাটি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নীতিনির্ধারকদের এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ‘সংশ্লিষ্ট নেতিবাচক প্রভাব’-এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়েছে, এর প্রভাবে মানবজীবন ও প্রকৃতির জন্য ‘গুরুতর পরিণতি’ নেমে আসবে।
আইসিআইএমওডির উপপরিচালক ইজাবেলা কোজিয়েল বলেন, ‘এশিয়ার ২০০ কোটি মানুষ হিমবাহ ও তুষারের পানির ওপর নির্ভরশীল। এই ক্রায়োস্ফিয়ার (পৃথিবীর হিমায়িত জলের অংশ) হারানোর পরিণতি চিন্তা করতে হবে। এ থেকে বিপর্যয় রোধ করতে এখনই আমাদের নেতাদের কাজ করতে হবে।’
ডেভিড রাউন্স বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী [নরফেলের] কৌশল বিবেচনায় নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিশ্বব্যাপী অনেক সম্প্রদায় যেমন চিলি ও মধ্য ইউরোপ এই পানিসম্পদের ওপর নির্ভর করে। তাই পানি-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য এই কৌশল একটি কার্যকর স্থানীয় সমাধান হতে পারে।’
নরফেল বলেন, তাঁর সহজ ও কম খরচের কৌশল একটি দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি। তিনি বলেন, ‘আমরা পানি তৈরি করতে পারি না, তবে উপলব্ধ উৎসগুলো ব্যবহার করতে পারি। গ্রামের মানুষকে নিয়ে আমরা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে সক্ষম, এমন ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি। এসব কৃত্রিম হিমবাহ গ্রামে জলের স্রোতকে ফিরিয়ে আনতেও সাহায্য করে গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প পানির উৎস হয়ে উঠতে পারে।’