জি–২০ সম্মেলন ঘিরে কার্যত বন্ধ থাকবে দিল্লি

জি–২০ সম্মেলন ঘিরে নয়াদিল্লি সাজানো হচ্ছে। ২২ আগস্ট তোলাছবি: এএফপি

এযাবৎ যা কখনো হয়নি, এই প্রথম ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সেটাই ঘটতে চলেছে। ৮ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানী দিল্লি সাধারণ মানুষের জন্য কার্যত বন্ধ থাকবে। ওই সময়ে জি–২০ শীর্ষ সম্মেলন যাতে নিরুপদ্রবে ও নিশ্চিন্তে কাটে, সে জন্য অভূতপূর্ব সব ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে।

ভারতের আমন্ত্রণে ওই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে দিল্লি আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর এমনিতেই সরকারি ছুটির দিন। কিন্তু এর সঙ্গে ৮ সেপ্টেম্বরও ছুটির তালিকায় তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ওই তিন দিন রাজধানীর সব সরকারি–বেসরকারি স্কুল–কলেজ, অফিস–কাছারি, ব্যাংক ও যাবতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে। দিল্লি বিমানবন্দর থেকে শহরে যাতায়াতের প্রতিটি রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার চায় না, সম্মেলনে হাজির হওয়া কোনো দেশ ও তাদের প্রতিনিধিদের অযথা হয়রানির মুখে পড়তে হোক।

সে জন্য দিল্লি পুলিশ এখন থেকেই ব্যাপক প্রচার শুরু করেছে। ওই তিন দিন মূল অনুষ্ঠানস্থল প্রগতি ময়দানের সবচেয়ে কাছের মেট্রোস্টেশন, যার পোশাকি নাম ‘সুপ্রিম কোর্ট’ বন্ধ রাখা হবে। ওই তল্লাটে অপ্রয়োজনীয় বলে চিহ্নিত কোনো গাড়ি চলতে দেওয়া হবে না। শুধু তা–ই নয়, ভিন রাজ্য দিল্লি হয়ে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ বা উত্তরাখন্ডে চলাচল করে, এমন ট্রাক বা যানবাহনকে অন্য রুট ধরে চলাচল করতে বলা হবে। পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া কোন ধরনের যান নয়াদিল্লির কোন কোন সড়কে চলতে দেওয়া হবে না, সেই তালিকা তৈরি করে প্রচার শুরু হয়েছে। ওই তিন দিন ঘিরে আগে–পিছে আরও দুই দিন দিল্লি পুলিশের সব ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

সম্মেলন উপলক্ষে দিল্লির সব বড় ও ভালো হোটেলের সব ঘর সরকার আগে থেকে অতিথিদের রাখার জন্য নিয়ে রেখেছে। বড় হোটেলের দৈনিক ঘর ভাড়া দাঁড়িয়েছে কয়েক লাখ টাকা। ওই তিন দিন বিদেশি পর্যটকদের কাছে দিল্লির দুয়ার কার্যত বন্ধ। পর্যটন সংস্থাগুলোতে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে, সম্মেলন চলাকালে সাধারণ পর্যটকদের দিল্লি আসতে বারণ করা হচ্ছে।

জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় দিল্লি যাতে ছিমছাম থাকে, সে জন্য নানা রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুরো রাজধানী মুড়ে ফেলা হয়েছে জি–২০–এর ‘লোগো’ দিয়ে। বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার মূল সড়কসহ প্রধান প্রধান সড়কের দুই ধার সাজানো হয়েছে। অগুনতি ফোয়ারা তৈরি হয়েছে। তা আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। রাস্তার ধারে ধারে সবুজায়নের জন্য বসানো হয়েছে ৯ লাখ নতুন গাছ। ফুলের গাছ ও বাহারি পাতা দিয়ে সাজানো হয়েছে রাস্তার ধার। ৮৩ ধরনের বাহারি ফুলের গাছসহ এক লাখ টব রাখা হয়েছে। মূল রাস্তাগুলো যাতে মসৃণ থাকে, সে জন্য নতুন করে পিচ ঢালা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা, ট্রাফিক মোড় থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে ভিখারি ও ফেরিওয়ালাদের। সম্মেলনের আগে কোনো রাস্তায় একজনও ভবঘুরে, ভিক্ষুক বা ফেরিওয়ালা যাতে না থাকে, সে জন্য দিল্লি পুলিশ বিশেষ ব্যবস্থা নিচ্ছে। এসব ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ দরিদ্র মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার একটা ব্লু প্রিন্ট দিল্লি পুলিশ তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে দিল্লি পুলিশ প্রেরণা পেয়েছে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে অনুষ্ঠিত ‘আর্থ সামিট’ থেকে। সে সময় রিও ডি জেনিরোর সব ফুটপাত ও রাস্তা থেকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ দরিদ্র ভিক্ষুকদের সরিয়ে একটি দ্বীপে আটকে রাখা হয়েছিল।

এক বছরের জন্য ভারত এই আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সভাপতিত্বের দায়িত্ব পেয়েছে। সে জন্য ২০২৩ সালে দেশের প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে চলেছে বিভিন্ন উৎসব ও সম্মেলন। সরকার এই অবসরে তুলে ধরতে চেয়েছে ভারতের ভাবমূর্তি। প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব। শাসক দল বিজেপির প্রচারে প্রধানমন্ত্রী মোদি ‘বিশ্বগুরু’।

কংগ্রেস অবশ্য সমালোচনা করতে ছাড়ছে না। দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেছেন, ‘এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এই গোষ্ঠীভুক্ত কোনো দেশই কখনো এমন ধরনের বাড়াবাড়ি করেনি। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দেশের মানুষের জ্বালাযন্ত্রণা–অভিযোগ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে জাঁকজমকের এই আতিশয্য।’

কংগ্রেস এখানেই থামেনি। অতীতের উদাহরণ দিয়ে জয়রাম বলেছেন, ১৯৮৩ সালে কংগ্রেস আমলে দিল্লিতে জোটনিরপেক্ষ ও কমনওয়েলথ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তখন এমন বাড়াবাড়ি করা হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্মেলনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে তোলা হয়নি।

দিল্লিতে এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছে একাধিকবার। কমনওয়েলথ গেমসও। কখনো জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়নি। এভাবে আগাম ছুটিও ঘোষিত হয়নি আন্তর্জাতিক কোনো সম্মেলন বা ক্রীড়ানুষ্ঠানের জন্য।

জি–২০ সম্মেলনের জন্য বাজেট বরাদ্দ ৯৯০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দের ওই অঙ্ক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এখনো অনুমান করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় বাজেটের বাইরে দেশের সব রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে বাড়তি যে খরচ করতে হচ্ছে, তা মোট বরাদ্দের পরিমাণের তিন গুণ দাঁড়াতে পারে বলে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো মহল মনে করছে।

জি–২০ সম্মেলনের ঢক্কা–নিনাদের মধ্যেই দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও সামাজিক পরিস্থিতির ‘প্রকৃত’ ছবি তুলে ধরতে বিরোধীরা সক্রিয়। দেশের ৫ শতাধিক অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক, আন্দোলনকর্মী, সাংবাদিক, সমাজসেবীদের নিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি জনসমক্ষে তুলে ধরার বিভিন্ন আয়োজন করেছে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন। জি–২০–এর আদলে সেই আয়োজনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘উই ২০’। বিভিন্ন রাজ্যে এই ব্যানারে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ও হচ্ছে।

সম্প্রতি দিল্লিতে সিপিএমের এক ভবনে ‘উই ২০’–এর এক আলোচনা সভায় যোগ দিতে দিল্লি পুলিশ সাধারণ মানুষকে বাধা দেয়। সেই আলোচনা সভা ছিল সিপিএম অফিসে। তাকে ঘিরে কোনো বিক্ষোভও কেউ করেনি। তবু পুলিশের বাধার মুখে পড়তে হয় সবাইকে। জয়রাম রমেশ সেই সভায় অংশ নেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে সিপিএম অফিস থেকে বেরোতে বাধা দেয়। পুলিশের অভিযোগ, ওই সভার আগাম অনুমতি নেওয়া হয়নি। সিপিএমের দাবি, দলের কোনো ভবনের অভ্যন্তরে কোনো আলোচনা সভার অনুমতি কখনো কাউকে নিতে হয় না।