লোকসভা ও রাজ্যসভা কি বিরোধীশূন্য করতে চাইছে বিজেপি

ভারতের সংসদে শীতকালীন অধিবেশনে বিরোধীদের প্রতিবাদ। ১৮ ডিসেম্বরছবি: এএনআই

ভারতীয় সংসদের দুই কক্ষ থেকে গণহারে বিরোধীদের বহিষ্কারের ধারা আজ মঙ্গলবারও অব্যাহত ছিল। গত সপ্তাহে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল ১৪ বিরোধী সদস্যকে। গতকাল সোমবার সংখ্যাটা রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭৮–এ। আজ মঙ্গলবার লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে আরও ৪৯ সদস্যকে। সব মিলিয়ে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে ১৪১ বিরোধী সদস্যকে দুই কক্ষ থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হলো।

বিরোধীদের অভিযোগ, সরকার সংসদকে এভাবে বিরোধীমুক্ত করে তুলতে চাইছে, যাতে বিতর্কিত সব বিল বিনা বাধায় ও বিনা আলোচনায় পাস করানো যায়।
স্বাধীন ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে অতীতে কখনো এত বিপুল পরিমাণে বিরোধী সদস্যদের বহিষ্কার করা হয়নি। ১৯৮৯ সালের ১৫ মার্চ লোকসভায় ঠক্কর কমিশনের প্রতিবেদন পেশ করার দাবিতে বিরোধীরা সরব হলে লোকসভা থেকে ৬৩ সদস্যকে তিন দিনের জন্য সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছিল। সেই সময় রাজীব গান্ধী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

ঠক্কর কমিশন গঠিত হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা তদন্তের জন্য। বিরোধীদের ধারণা ছিল, কমিশনের প্রতিবেদনে ইন্দিরার সহকারী রাজেন্দ্র কুমার ধাওয়ানের যোগসাজশের উল্লেখ আছে। তাঁরা দাবি জানাচ্ছিলেন, সভায় সেই প্রতিবেদন পেশ করা হোক।

এযাবৎ সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় নিদর্শন। কিন্তু ১৩ ডিসেম্বর সংসদে হামলাকে কেন্দ্র করে এবার যা ঘটছে তা অভূতপূর্ব ও অদৃশ্যপূর্ব। সেই হামলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আজ পর্যন্ত সংসদের কোনো কক্ষে বিবৃতি দেননি। বিরোধীরা দাবি জানিয়ে আসছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সভায় আসুন। বিবৃতি দিন। হামলার দায় গ্রহণ করুন। অথচ লোকসভার স্পিকার কিংবা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান কেউই সেই দাবিকে আমল দিচ্ছেন না।

বিরোধীদের আরও ক্ষোভ এই কারণে, সংসদ চলা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। কিন্তু সংসদে কিছু বলছেন না। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা সংসদের গরিমায় আঘাত করছেন। সম্মানহানি করছেন। সংসদ সদস্যদের অধিকারও হরণ করছেন। ক্ষুব্ধ সংসদ সদস্যদের প্রশমিত করে সভা চালাতে ব্যর্থ দুই সভাধ্যক্ষ দফায় দফায় বিরোধীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন। আজ মঙ্গলবারের পর মনে করা হচ্ছে, সংসদ কার্যত বিরোধীশূন্য হতে চলেছে।

বিরোধীদের সাময়িক বরখাস্তের প্রস্তাব আনা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সভাধ্যক্ষ তা মেনেও নিচ্ছেন। আজ মঙ্গলবার বহিষ্কারের পর সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি বলেন, নির্বাচনে হারার পর বিরোধীরা মরিয়া হয়ে অধিবেশন কক্ষে পোস্টার–ব্যানার আনতে শুরু করেছেন। অথচ তা নিষিদ্ধ। তাই এই ব্যবস্থা।

আজ বহিষ্কৃত সদস্যরা সংসদ ভবনের সদরে ধরনা দেন ও ‘নকল অধিবেশন’ বসান। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা সদস্য কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সভাধ্যক্ষের ভূমিকায় এমন আচরণ করেন, যার সঙ্গে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের হাবভাবের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। ধনখড়কে ‘নকল’ করা দেখে অন্য সংসদ সদস্যরাও মজা পাচ্ছিলেন। একটা সময় দেখা যায়, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী নিজের মুঠোফোনে তা রেকর্ড করছেন।

এ নিয়ে বিজেপি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। যে সময় ওই নকল সংসদের আয়োজন করা হয়েছিল, তখন বিজেপির সংসদীয় দলের বৈঠক চলছিল। নকল অধিবেশনের খবর সেখানে পৌঁছাতে প্রধানমন্ত্রী বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, এ জিনিস চলতে দেওয়া যায় না।

বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্র, আরএসএস নেতা সুনীল দেওধরসহ অনেকেই ‘এক্স’ হ্যান্ডলে বিরোধীদের আচরণের সমালোচনা করেন। সম্বিত পাত্র বলেন, উপরাষ্ট্রপতিকে নিয়ে হাসি–মশকরা করা হচ্ছে অথচ রাহুল তার ভিডিও করছেন। দেশ এটা মনে রাখবে। সুনীল দেওধর লেখেন, এটাই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের আসল রূপ। বিরোধীরা না শোধরালে ২০২৪ সালে আরও আসন কমে যাবে।

সংসদ থেকে গণহারে বিরোধীদের বহিষ্কারবিরোধী ঐক্যকে জোরদার করবে কি না—সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরে উঠতে শুরু করেছে। আজ বিকেলে অশোকা হোটেলে বসছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। সেই বৈঠকে আগামী লোকসভা ভোটের বিরোধী রণনীতি তৈরির পাশাপাশি রাজ্যে রাজ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা হবে। দেখার বিষয়, বিজেপির মোকাবিলায় বিরোধীরা কতটা জোটবদ্ধ থাকতে পারে।