আশঙ্কা ও বিতর্কের মধ্যে ভারতে চালু হলো নতুন ফৌজদারি আইন

প্রবল আশঙ্কা ও বিতর্ককে সঙ্গী করে আজ সোমবার থেকে সারা দেশে চালু হয়ে গেল ভারতীয় ন্যায় সংহিতাসহ তিন ফৌজদারি আইন। সরকারের দাবি, এই তিন আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তারা মুছে দিল ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় ব্রিটিশ প্রভাব। প্রতিষ্ঠা করল অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু সাজা দেওয়ার পরিবর্তে ন্যায়ের ধারণা।

সরকারি এই দাবির বিপরীতে বিরোধীরা মনে করছে, পুলিশ ও শাসকগোষ্ঠীর হাতে এই আইন আরও মাত্রাছাড়া ক্ষমতা তুলে দেবে, ভবিষ্যতে অবশ্যই যার অপব্যবহার হবে। এ ছাড়া গোটা দেশে দেখা দেবে অভূতপূর্ব আইনি জটিলতা।

গত বছর সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে উভয় কক্ষের মোট ১৪৬ বিরোধী সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করে সরকার এই তিন আইন প্রায় বিনা আলোচনায় পাস করিয়েছিল। তারপর তা পাঠানো হয়েছিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে। কমিটির অনুমোদনের পর জানানো হয়েছিল, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে সারা দেশে তিন আইন কার্যকর হবে।

বিজেপি সরকারের নতুন এই তিন আইন রুখতে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। বিরোধীরা সংসদে মুলতবি প্রস্তাবও পেশ করেছিল। কিন্তু তাতে আইন কার্যকর হওয়া ঠেকানো যায়নি।

নতুন আইনে দেশের বিভিন্ন অংশে মামলা করা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে এক মোটরবাইক চুরির অভিযোগে নতুন আইনে প্রথম মামলা হয়েছে। দিল্লিতে আজ সোমবার মামলা হয়েছে এক হকারের বিরুদ্ধেও।

গত বছর সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে উভয় কক্ষের মোট ১৪৬ বিরোধী সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করে সরকার এই তিন আইন প্রায় বিনা আলোচনায় পাস করিয়েছিল।

ভারতীয় দণ্ডবিধি বা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, ফৌজদারি দণ্ডবিধি বা ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর কোড ও সাক্ষ্য আইন বা এভিডেন্স অ্যাক্ট—তিন আইনই তৈরি হয়েছিল যথাক্রমে ১৮৬০, ১৮৯৮ ও ১৮৭২ সালে। স্বদেশীকরণের তাগিদে ওই তিন আইন বদলে নরেন্দ্র মোদি সরকার তৈরি করে তিন নতুন আইন। ‘ভারতীয় দণ্ডবিধি’র বদলে তৈরি করা হয় ‘ভারতীয় ন্যায় সংহি’তা, ‘ফৌজদারি দণ্ডবিধি’র বদলে ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ ও ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট’-এর বদলে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’।

আশঙ্কা, নতুন আইন রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে প্রভূত ক্ষমতা তুলে দেবে, যার অপব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষকে ভুগতে হবে। দেশের আইনজীবীদের একাংশের পাশাপাশি বিরোধীদের অভিযোগ এমনই। ব্রিটিশ জমানার আইনে দেশদ্রোহ–সংক্রান্ত ধারা ছিল। তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টও নানা সময়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও ওই আইনের যৌক্তিকতা কোথায়? নতুন আইনে রাষ্ট্রদ্রোহ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। যদিও বিরোধী মহল ও আইনজীবীদের অনেকে মনে করছেন, নতুন আইন আরও কঠোর এবং তা নাগরিক অধিকার আরও বেশি করে খর্ব করবে।

রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ বাদ পড়লেও নতুন আইনে দেশের সার্বভৌমত্ব, একতা ও অখণ্ডতা বিপন্নের চেষ্টা রুখতে যে বিধান দেওয়া হয়েছে, তা আরও কঠোর শাস্তি। বিরোধীদের দাবি, রাষ্ট্রদ্রোহ না থাকলেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সার্বভৌমত্ব খর্বের চেষ্টা, সশস্ত্র সংগ্রাম ইত্যাদির নির্দিষ্ট সংজ্ঞাই দেওয়া নেই। সরকারের সমালোচনা ও রাষ্ট্রের সমালোচনা সমার্থক হয়ে যাবে।

বিজেপি সরকারের নতুন এই তিন আইন রুখতে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। বিরোধীরা সংসদে মুলতবি প্রস্তাবও পেশ করেছিল।

বিরোধীরা বলছে, পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বল্গাহীন ক্ষমতা। সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে দেশে ইউএপিএ আইন আগে থেকেই চালু রয়েছে। তা সত্ত্বেও নতুন আইনে সন্ত্রাসবাদের বিধান রাখা হয়েছে, যার কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাসহ যেকোনো সাধারণ মানুষকে বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেলে পুরে রাখা যেতে পারে। জামিন পাওয়াই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।

সরকারের অবশ্য দাবি, নতুন এ আইনে বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ হবে। সেই লক্ষ্যে বলা হয়েছে, যেকোনো ফৌজদারি মামলার রায় বিচার শেষ হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে দিতে হবে। প্রথম শুনানির ৬০ দিনের মধ্যে অভিযোগ গঠন করতে হবে। সাক্ষীদের সুরক্ষা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সব রাজ্য সরকারকে সাক্ষী সুরক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

নতুন আইনের কিছু ভালো দিকও অবশ্য রয়েছে। যেমন এখন থেকে অনলাইনে যেকোনো অভিযোগ জানানো যাবে। ‘জিরো এফআইআর’ দাখিল করা যাবে। জিরো এফআইআর হলো যেকোনো ব্যক্তির যেকোনো অভিযোগ যেকোনো থানায় করার অধিকার। সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্ব সেই অভিযোগ আসল থানার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া।

আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত করার স্বার্থে ই-মেইল মারফত সমন জারি করা যাবে। ঘৃণ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধস্থলের ভিডিওগ্রাফ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রতিটি থানায় রেজিস্টার ও ই-রেজিস্টার রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোন অভিযুক্ত পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন, প্রতিটি থানায় সেই তালিকা থাকবে।

নতুন আইনে দেশের বিভিন্ন অংশে মামলা শুরু হয়েছে। রোববার দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে এক মোটরবাইক চুরির অভিযোগে নতুন আইনে প্রথম মামলা হয়েছে। দিল্লিতে আজ সোমবার মামলা হয়েছে এক হকারের বিরুদ্ধেও।

ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় দণ্ডবিধিতে গণপ্রহার বা গণপিটুনি নিয়ে আলাদা কোনো বিধান ছিল না। নতুন ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় গণপ্রহারসংক্রান্ত ধারা যুক্ত হয়েছে। গণপিটুনিতে মৃত্যু হলে সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। এত দিন এভাবে মৃত্যুর ঘটনার মামলা রুজু করা হতো খুন বা খুনের চেষ্টার ধারায়।

বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস এবং তারপর নারীকে পরিত্যাগ করলে নতুন আইনে কড়া শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সদ্যোজাত সন্তান কেনাবেচা জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। গণধর্ষণের শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হলে যেকোনো হাসপাতালে তাঁদের বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

মামলার দীর্ঘস‍ূত্রতা এই উপমহাদেশের বিচারব্যবস্থার কঠিন রোগ। এর সুরাহায় নতুন আইনে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী দুই পক্ষই ১৪ দিনের মধ্যে এজাহারের কপি, পুলিশি প্রতিবেদন, অভিযোগপত্র, জবানবন্দি, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিসহ অন্যান্য নথি পাওয়ার অধিকারী।

এ দেশের মামলায় তারিখের পর তারিখ আসে, শুনানি হয় না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও নতুন আইনে রাখা হয়েছে। বিলম্ব এড়াতে আদালত এবার থেকে যেকোনো মামলায় সর্বোচ্চ দুবার স্থগিতাদেশ দিতে পারবেন। নতুন আইনে এই প্রথম ‘লিঙ্গ’-এর সংজ্ঞায় তৃতীয় লিঙ্গকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আজ সোমবার দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, এই আইন নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক নয়। দেশবাসীর কথা মনে রেখেই এই আইন তৈরি। এ নিয়ে আলোচনার জন্য সরকারের দরজা সব সময় খোলা থাকবে।