মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেজরিওয়ালের
আবগারি (মদ) মামলায় জামিনে মুক্তি পাওয়ার দুই দিন পর দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির (আপ) সর্বোচ্চ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল পদত্যাগের কথা জানালেন।
আজ রোববার বেলা ১১টা নাগাদ এই ঘোষণা দেন কেজরিওয়াল। বলেন, দুই দিনের মধ্যেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার পর এবার মানুষের রায় চাইবেন।
কেজরিওয়ালের জায়গায় কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, দল তা ঠিক করবে। আতিশি, রাঘব চাড্ডা, সৌরভ ভরদ্বাজের মধ্য থেকে কেউ হতে পারেন। এত দিন ধরে সরকারের সব কাজ চালিয়ে আসছেন আতিশিই।
ছয় মাস জেলবন্দী থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে দলীয় কর্মীদের এক বৈঠকে এই ঘোষণা দিয়ে কেজরিওয়াল বলেন, তিনি চান, দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ডের সঙ্গে এই নভেম্বর মাসেই করা হোক।
দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে।
কেজরিওয়াল ও আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া ও অর্থ পাচারের গুরুতর অভিযোগে তদন্ত চলছে। অভিযোগ, আবগারি নীতির মাধ্যমে তাঁরা ১০০ কোটি রুপি ঘুষ নিয়েছেন। সেই টাকা গোয়া বিধানসভা ভোটে খরচ করেছেন। এই অভিযোগের তদন্ত করছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), সিবিআই ও আয়কর বিভাগ। কেজরিওয়াল ছাড়াও ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়া, রাজ্যসভার সদস্য সঞ্জয় সিংকে। কিন্তু এখনো অকাট্য প্রমাণ তারা দাখিল করতে পারেনি।
দুই বছর ধরে বিজেপি কেজরিওয়ালের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কেজরিওয়াল আমলে নেননি। এখন নিলেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর। দাবি জানালেন, দ্রুত নির্বাচনের। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, তিনি চাইছেন সহানুভূতির হাওয়া ধরে রেখে ভোটে যেতে। জনগণের রায়ের ওপর ভরসা রাখতে।
দলীয় কর্মীদের কেজরিওয়াল বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার পর এবার আমি জনতার দরবারে হাজির হব। জনতার রায় চাইব। দিল্লির জনগণ চাইলে আবার আমি মুখ্যমন্ত্রী হব। তার আগে দলের নেতারা ঠিক করবেন, অন্তর্বর্তী সময়ে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। সে জন্য দুয়েক দিনের মধ্যেই পরিষদীয় দলের বৈঠক ডাকা হবে।’
পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দলীয় কর্মীদের সভায় কেজরিওয়াল তুলোধুনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলকে। তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকারের চেয়েও বড় স্বৈরতন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীদের হেনস্তার জন্য তাঁর সরকার সব করেছে। তারা আমাকে জেলে পাঠিয়েছে। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া, কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। এটা করেছে দল ভাঙাতে। বিধায়ক ভাঙাতে।’
কেজরিওয়াল বলেন, ‘এটাই বিজেপির চাল। যেখানে সরকার গড়তে ব্যর্থ, সেখানে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীদের জেলে পাঠিয়ে সরকার দখল করতে চায়। সেই সুযোগ আমি ওদের দিইনি। তাই পদত্যাগ করিনি। দলও ভাঙেনি। আমি সব সময় চেয়েছি গণতন্ত্রকে বাঁচাতে। এখন করতে চাইছি জনগণের রায় মাথা পেতে নিতে।’
কেজরিওয়ালের এই সিদ্ধান্ত নিশ্চিতই এক রাজনৈতিক ‘মাস্টার স্ট্রোক’। কারণ, তিনি জানেন, সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পর তাঁর প্রতি সহানুভূতির একটা হাওয়া বইছে। তবে সেই হাওয়া ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধরে রাখা কঠিন। দ্বিতীয়ত, বিজেপি তাঁর ইস্তফার দাবিতে অটল। এত দিন সেই সুযোগ না দিয়ে এখন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বিজেপির পালের হাওয়া কেড়ে নেবে। তৃতীয়ত, তাঁকে গ্রেপ্তার ও তদন্তের নামে ইডি, সিবিআই যা করেছে, সুপ্রিম কোর্ট তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। সেই মন্তব্য তাঁর প্রচারের কাজে আসবে। চতুর্থত, এই সিদ্ধান্ত দলকেও জোটবদ্ধ রাখতে সাহায্য করবে।
তা ছাড়া এই সিদ্ধান্ত আপ বা দিল্লি সরকারকে নতুনভাবে কোনো অসুবিধের মধ্যে ফেলবে না। দিল্লি দেশের রাজধানী হওয়ায় পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়নি। হয়তো পাবেও না। তার ওপর আইন করে দিল্লির নির্বাচিত সরকারের চেয়ে ক্ষমতাবান করা হয়েছে উপরাজ্যপালকে। তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয় না। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী উপরাজ্যপাল। তার ওপর দিল্লির পুলিশ কেন্দ্রের অধীনে। দিল্লির জমি–সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্তও কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভর করে। গ্রেপ্তারের আগে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল নিজের হাতে কোনো দপ্তরও রাখেননি। বলতে গেলে তিনি ছিলেন নামেই মুখ্যমন্ত্রী। কাজেই মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়লেও সরকারকে অসুবিধায় পড়তে হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী কেজরিওয়াল দিল্লি সরকারের সচিবালয়ে যেতে পারবেন না। ফাইলে সই করতে পারবেন না। এত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কাজ করার চেয়ে পদত্যাগ করে জনতার রায় মাথা পেতে নেওয়ার কথা জানানোটা তিনি তাঁর পক্ষে সেরা মনে করেছেন।
গত ১০ বছর ধরে দিল্লিতে লোকসভার একটি আসনও কেজরিওয়ালের দল জেতেনি। সব আসন রয়েছে বিজেপির দখলে। কিন্তু বিধানসভায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে আপ রয়েছে ক্ষমতায়। এবারেও সাত লোকসভা আসন জিতেছে বিজেপি। কিন্তু আপ মনে করছে, বিধানসভায় তারাই বাজি মারবে। সেই জন্য এই পদক্ষেপ।
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত একটি সাংবিধানিক প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের অর্থ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ। এ ক্ষেত্রেও তেমনই হওয়ার কথা। কিন্তু কেজরিওয়াল বলেছেন, তাঁর জায়গায় অন্য কেউ মুখ্যমন্ত্রী হবেন। তার অর্থ পরিষদীয় দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া। সে ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয় না। মুখ্যমন্ত্রীর বদল ঘটে শুধু। এ ক্ষেত্রে কেজরিওয়াল কী করবেন সে দিকে তাই নজর থাকছে।