জম্মু-কাশ্মীরে মোদির নীতির বিরুদ্ধে ভোট দিল জনগণ
সব সমীক্ষা ভুল প্রমাণিত করে হরিয়ানায় ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠল বিজেপি। উত্তর ভারতের এই রাজ্যে উপর্যুপরি তৃতীয়বার ক্ষমতাসীন থাকার রেকর্ড সৃষ্টি করল তারা। হরিয়ানায় সফল হলেও জম্মু-কাশ্মীরে বিজেপি ব্যর্থ। পাঁচ বছর ধরে নানা চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে ক্ষমতায় আসতে পারল না কেন্দ্রের শাসক দল। নরেন্দ্র মোদির ‘কাশ্মীর নীতি’ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যাত হলো। সেখানে ক্ষমতায় আসতে চলেছে ন্যাশনাল কনফারেন্স (এসি), কংগ্রেস ও সিপিএমের জোট।
বেলা তিনটার হিসাব অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীরের ৯০ আসনের মধ্যে এনসি-কংগ্রেস জোট ৪৯ আসনে এগিয়ে। বিজেপি ২৯টিতে। পিডিপির আসন কমে হয়েছে ৩। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির কন্যা ইলতিজা হেরে গেছেন। পিপলস কনফারেন্সের সাজ্জাদ লোন ছাড়া এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির এক প্রার্থী। বাকিরা স্বতন্ত্র।
বেলা দুটায় এনসি নেতা ফারুক আবদুল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ রায় দিয়েছে। ওমর আবদুল্লাহই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। ওমর গান্দরবাল ও বদগাম দুই আসন থেকেই জিতেছেন।
হরিয়ানা বিধানসভার মোট আসনও ৯০। বিজেপি ৪৭ আসনে এগিয়ে। কংগ্রেস ৩৭টিতে। আর ইন্ডিয়ান লোক দল ৩টি আসনে। ৩ জন স্বতন্ত্র। এই রাজ্যে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে জেজেপি। গতবার তারা ১০টি আসন জিতে বিজেপিকে সরকার গড়তে সাহায্য করেছিল।
এই ফল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যতটা উৎফুল্ল করবে, ততটাই চিন্তিত। উৎফুল্ল করবে কেননা, তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি হরিয়ানায় হ্যাটট্রিক করল। রাজ্যের ইতিহাসে এটা রেকর্ড। ১০ বছর ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও আগেরবারের তুলনায় আসন বাড়িয়ে বিজেপির সরকার গড়ার মতো অবস্থায় চলে আসা অবশ্যই মোদির কৃতিত্ব।
তবে প্রধানমন্ত্রীকে চিন্তায় রাখবে জম্মু-কাশ্মীরের ব্যর্থতা। প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে তাঁর কাশ্মীর নীতিকে। দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরেও। কারণ, এই ভোট এক অর্থে ছিল ৩৭০ অনুচ্ছেদ–সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গণভোট। মোদি এই রাজ্যকে এনসি, কংগ্রেস ও পিডিপির হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই ইচ্ছাও ব্যর্থ হলো।
সেই অর্থে দুই বিধানসভার ফলই বিস্ময়কর।
বেশি বিস্ময় অবশ্যই হরিয়ানার ফলে। কারণ ভোটের আগে সব জনমত সমীক্ষা এবং ভোটের পর প্রতিটি বুথ ফেরত জরিপ কংগ্রেসকে বিপুলভাবে জয়ী দেখিয়েছিল। কোনো জরিপেই কংগ্রেসের সম্ভাব্য আসন ৫০টির নিচে কেউ দেখায়নি। কেউ কেউ বলেছিল, কংগ্রেস ৭০টি আসনও পেতে পারে। ধারণা এতই দৃঢ় ছিল যে দিল্লিতে কংগ্রেস দপ্তরে উৎসব পালনের সব ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
প্রাথমিক গণনায় কংগ্রেস এগিয়ে যেতে মিষ্টি বিলিও শুরু হয়েছিল। কেউ ভাবেনি, ছবিটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে। বেলা সাড়ে ১০টা থেকে ভাগ্যের পেন্ডুলাম বিজেপির দিকে ঢলে পড়তে থাকে। দেখা যায়, হরিয়ানার জাট প্রভাবিত অঞ্চলেও বিজেপি ভালো ফল করেছে। দুপুর সাড়ে ১২টায় বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা মুখ্যমন্ত্রী নায়েব সিং সাইনিকে অভিনন্দন পর্যন্ত জানিয়ে দেন।
কী করে এমন সম্ভব, দিনভর তা নিয়েই চলে চর্চা। হরিয়ানার ভোট পরিচালনার দায়িত্ব কংগ্রেস নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিল সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও জাট নেতা ভূপিন্দর সিং হুডার ওপর। প্রার্থীদের সিংহভাগ দখল করেছিলেন তাঁর অনুগামীরা। কংগ্রেসের দলিত নেত্রী সংসদ সদস্য কুমারী শৈলজা কিছুদিন অভিমান করে প্রচারে নামেননি। পরে তিনি সক্রিয় হলেও মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি জানিয়ে রেখেছিলেন।
ভোটের ফলে দেখা গেছে, দলিত আসনগুলোয় কংগ্রেস খারাপ না করলেও জাটভূমিতে কংগ্রেসের চেয়ে বিজেপি তুলনামূলক ভালো করেছে। জাটদের বিরুদ্ধে অ-জাট ভোট জোটবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিজেপি আগেরবারের মতো এবারেও সফল। গত বছর মধ্য প্রদেশ ও ছত্তিশগড় বিধানসভার ফলেরই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল হরিয়ানায়।
হরিয়ানায় বিজেপির সাফল্য যতখানি, ঠিক ততখানিই প্রকট কংগ্রেসের ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতার একটা প্রধান কারণ প্রার্থী মনোনয়ন এবং হুডার প্রতি অতি নির্ভরতা। কংগ্রেস একই রকম ব্যর্থ জম্মুতেও। সেখানে হিন্দু প্রধান অঞ্চলে বিজেপির বিরুদ্ধে তারাই ছিল প্রবল প্রতিপক্ষ। কিন্তু প্রার্থী বাছাইয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থতার দরুন প্রতিটি আসনেই তারা পর্যুদস্ত হয়েছে। জম্মুতে কংগ্রেস-এনসি জোট যে আসনগুলো পেয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিই মিশ্র এলাকায়। উপত্যকায় কংগ্রেস জিতেছে এনসির বদান্যতায়।
জম্মু-কাশ্মীরের ভোটের ফল মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতি অসাড়ত্ব প্রমাণ করে দিল। সাবেক এই রাজ্যের জনগণ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলেন, যে লক্ষ্যে পাঁচ বছর আগে বিজেপি এই রাজ্য দ্বিখণ্ডিত করেছিল, সংবিধান প্রদত্ত ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করেছিল, পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সৃষ্টি করেছিল, জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই অর্থে এই ফল নিশ্চিতভাবে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে গণভোট।
অথচ কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেনি। লোকসভা ও বিধানসভার কেন্দ্রগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে সাতটি আসন বাড়িয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৬টি হিন্দু প্রধান জম্মুতে, মুসলমান প্রধান কাশ্মীর উপত্যকায় মাত্র ১টি। দুই অঞ্চলের আসনের মধ্যে যেখানে ৯ আসনের ফারাক ছিল, তা কমিয়ে করা হয় ৪টি। শুধু তা–ই নয়, আইন করে উপরাজ্যপালকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিধানসভায় পাঁচজনকে মনোনীত করার, যাঁদের মধ্যে তিনজন থাকবেন নারী।
মন্ত্রিসভাকে এড়িয়ে সেই মনোনয়নের চেষ্টা গতকাল সোমবার রাতেই শুরু হয়, যার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার হুমকি দিয়েছে এনসি। এত চেষ্টা সত্ত্বেও এনসি-কংগ্রেস জোট তর্কাতীতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পথে। এই ফল মোদির কাশ্মীর নীতির পরাজয় ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রশ্ন হলো, অতপর? প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার কি জম্মু-কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবে? দিলে কবে?
এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের কোনো উত্তর এখনো নেই। বরং এমন শঙ্কা দেখা দিচ্ছে, যেভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কেন্দ্রশাসিত দিল্লি উপরাজ্যপাল মারফত শাসিত হচ্ছে, জম্মু-কাশ্মীর ঠিক সেভাবেই শাসিত হবে। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পৌরসভার চেয়ারম্যানের বেশি হবে না।
কাশ্মীর উপত্যকায় এনসি-কংগ্রেস-সিপিএম জোট এবং পিডিপির প্রাধান্য খর্ব করতে বিজেপি অন্য ব্যবস্থাও করেছিল। যেমন, বিচ্ছিন্নতাবাদী জেলবন্দী সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টি (এআইপি) গঠনে মদদ, জামায়াতে ইসলামীকে স্বতন্ত্রভাবে ভোটে দাঁড়াতে উৎসাহিত করা এবং গুলাম নবি আজাদ ও আলতাফ বুখারির দলকে খোলামেলা সমর্থন করা।
বিজেপি উপত্যকায় মাত্র ১৯ কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু ফল দেখে বোঝা যাচ্ছে, বিজেপির প্রতিটি কৌশল উপত্যকার মানুষ ব্যর্থ করেছে। প্রবল সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছে এনসি-কংগ্রেস জোটের পক্ষে। একদা প্রবল প্রতাপান্বিত দল পিডিপিও এই ভোটে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। বোঝা গেল, ২০১৪ সালের ভোটের পর বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে তাদের সরকার গড়া উপত্যকার মানুষ মেনে নেয়নি।