মুম্বাই হামলায় অভিযুক্ত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত তাহাউর রানাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে প্রত্যর্পণ

সন্ত্রাসী হামলার পর মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল থেকে ধোঁয়া ও আগুন উঠছে। ২৭ নভেম্বর ২০০৮ফাইল ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরভিত্তিক ব্যবসায়ী তাহাউর রানাকে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলায় অভিযুক্ত এই ব্যক্তিকে বৃহস্পতিবার দিল্লিতে আনা হয়েছে। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

শিকাগোতে ব্যবসা করলেও তাহাউর রানা ছিলেন কানাডার নাগরিক। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত মুম্বাই হামলার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দিয়েছিলেন। কিন্তু হামলার সঙ্গে জড়িত একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তা দেওয়ার দায়ে আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের ওই হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৬৬ জন।

তাহাউর রানাকে ২০১৩ সালে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই আদালত। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালে ৬৪ বছর বয়সী রানাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন ভারত তাঁকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানালে ওই বছরের শেষের দিকে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত ২০২৩ সালে তাহাউর রানাকে ভারতে প্রত্যর্পণের অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগপর্যন্ত তিনি নিরাপত্তা হেফাজতে ছিলেন।  

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটনে বৈঠক করেন। এই বৈঠকের পর তাহাউর রানার প্রত্যর্পণ মঞ্জুর করেন ট্রাম্প।

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাহাউর রানা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। আদালত তাঁর আবেদন নাকচ করে দেন। ১৯৯৭ সালে হওয়া ভারত-মার্কিন প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় তাঁকে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে।

তাহাউর রানা কে

তাহাউর রানা
ফাইল ছবি: এএনআই

তাহাউর রানা বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে যোগদানের আগে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁর স্ত্রীও একজন চিকিৎসক। তাঁরা উভয়ে ২০০১ সালে কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করেন।

পরে তাহাউর রানা শিকাগো চলে যান। সেখানে তিনি একাধিক ব্যবসা পরিচালনা করতেন। তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি অভিবাসন ও ভ্রমণ সংস্থাও রয়েছে।
তাহাউর রানার বিরুদ্ধে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, তিনি শৈশবের বন্ধু ডেভিড কোলম্যান হেডলির সঙ্গে যোগসাজশে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর ই-তাইয়েবাকে সহায়তা করতেন। মুম্বাই হামলার জন্য এই সংগঠনটিকেই দায়ী করা হয়।
এই সংগঠনের ১০ জন সদস্য ২০০৮ সালের ২৬ থেকে ২৯ নভেম্বরের মধ্যে মুম্বাইয়ের একাধিক জায়গায় হামলা চালান। হামলার শিকার স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে মুম্বাইয়ের একটি ট্রেনস্টেশন, একাধিক হোটেল, ক্যাফে ও একটি ইহুদি কেন্দ্র।

সন্ত্রাসীরা এসব স্থানে গুলি চালায় ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ে লস্কর ই-তাইয়েবাকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস বা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস রেলওয়ে স্টেশন এক অস্ত্রধারী। ২৬ নভেম্বর ২০০৮
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মুম্বাই হামলা মামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌঁসুলিরা বলেন, তাহাউর রানা ২০০৬ সালে হেডলিকে মুম্বাইয়ে নিজের শিকাগোভিত্তিক অভিবাসন সংস্থার একটি শাখা খোলার অনুমতি দেন। এটিকে স্কাউট কেন্দ্রের ছদ্মবেশে ২০০৮ সালের হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়।

তাহাউর রানার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তিনি হেডলিকে তাঁর সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই অনুমতি নিয়ে হেডলি বিজ্ঞাপন দেওয়ার অজুহাতে সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে যেতে পারতেন।

হেডলি স্বীকার করেছেন, তাঁর সঙ্গে লস্কর ই-তাইয়েবা এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তবে পাকিস্তান এই সব সংশ্লিষ্টতার কথা বারবার অস্বীকার করেছে। হেডলি রানার বিরুদ্ধেও সাক্ষ্য দিয়েছেন।

রানার আইনজীবীরা তখন অভিযোগ করেছিলেন, তিনি হেডলির দ্বারা বিভ্রান্তি ও কারসাজির শিকার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্কুলে পড়ার সময়ে রানা ও হেডলির মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন
তাজ হোটেল থেকে এক অতিথিকে সরিয়ে নিচ্ছে পুলিশ। ২৭ নভেম্বর ২০০৮
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০১১ সালে শিকাগোর কেন্দ্রীয় আদালতের জুরি সদস্যরা লস্কর ই-তাইয়েবাকে সহায়তা দেওয়া এবং ডেনমার্কের সংবাদমাধ্যম জিল্যান্ডস পোস্টেনে একটি ব্যর্থ হামলা পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখার অভিযোগে রানাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তাঁর বিরুদ্ধে মুম্বাই হামলায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও আদালত তাঁকে সে অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিলেন। ওই অভিযোগ থেকে খালাস পেলেও হামলাকারী সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

মুম্বাই হামলায় জড়িত অভিযোগে পাকিস্তানি-আমেরিকান নাগরিক হেডলিকে ৩৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে শিকাগোর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়।

তাহাউর রানার বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ

মুম্বাই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাহাউর রানা ও হেডলির অনুপস্থিতিতে মুম্বাইয়ের একটি আদালতে তাঁদের বিচার হয়েছিল। পরে মামলাটিতে লড়তে সম্মত হয়েছিলেন হেডলি।

ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা (এনআই) সংস্থা তাহাউর রানার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ষড়যন্ত্র, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশটির একটি নিম্ন আদালতে করা আপিলে তাহাউর রানা বলেছিলেন, যে অপরাধের জন্য মার্কিন আদালত তাঁকে খালাস দিয়েছেন, সেই একই অভিযোগে ভারতে তিনি দণ্ডিত হতে পারেন।

কিন্তু রানার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। আবেদন নাকচ করে আদালত বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যে অভিযোগ থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন, ভারতের অভিযোগগুলো সেগুলোর থেকে আলাদা।

পরে প্রত্যর্পণে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে রানার আইনজীবীরা বলেছিলেন, তাঁকে প্রত্যর্পণ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের আইন এবং জাতিসংঘের কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার লঙ্ঘিত হবে। তাঁদের যুক্তি ছিল, ভারতে প্রত্যর্পণ করা হলে আবেদনকারী নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। এই বিষয়টি বিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে।

তাহাউর রানার পক্ষে করা আবেদনে আরও বলা হয়েছিল, ‘এই মামলায় [আবেদনকারী] নিপীড়নের শিকার হওয়ার শঙ্কা বরং বেশি। কারণ মুম্বাই হামলায় অভিযুক্ত এই আবেদনকারী পাকিস্তান বংশোদ্ভূত মুসলমান।’

আবেদনে রানার স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং ভারতের কারাগারে তিনি কেমন আচরণ পাবেন, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল।

মুম্বাই মামলার কৌঁসুলি উজ্জ্বল নিকম ভারতের সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, তাহাউর রানাকে প্রত্যর্পণের মধ্য দিয়ে মুম্বাই হামলার সঙ্গে ‘পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিভাগগুলোর জড়িত’ থাকার বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।