সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চার রাজ্যের নির্বাচন একসঙ্গে কেন দিচ্ছে না মোদি সরকার
এত দিন ধরে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির পক্ষে জোরাল সওয়াল করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে ভাষণেও সারা দেশে একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। অথচ তাঁরই নিযুক্ত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার চার রাজ্য ও এক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভার ভোট গ্রহণ করতে চলেছেন আলাদাভাবে।
কেন্দ্রশাসিত জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার ভোট হবে পাক্কা ১০ বছর পর। শেষবার ভোট হয়েছিল ২০১৪ সালে। বাকি তিন রাজ্য মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খন্ড বিধানসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) অনায়াসেই এই তিন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত জম্মু–কাশ্মীরের ভোট একই সঙ্গে করাতে পারত। কিন্তু তা না করে ঘোষণা করা হলো শুধু জম্মু–কাশ্মীর ও হরিয়ানার ভোটের তফসিল।
জম্মু–কাশ্মীরে ভোট হবে তিন দফায়, ১৮ ও ২৫ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর। হরিয়ানার ভোটও ১ অক্টোবর। গণনা ৪ অক্টোবর। মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ড বিধানসভার ভোটের তারিখ ঘোষণা করা হবে পরে।
এই চার বিধানসভার নির্বাচন ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ৪৬টি বিধানসভা ও কেরালার ওয়েনাড লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু ইসি সেগুলোর তারিখও ঘোষণা করেনি। সংগত কারণেই বিরোধীদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসি। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক দল বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সুবিধা করে দিতেই এই ছাড়া ছাড়া ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি প্রচারের সুযোগ পাবেন। সরকারও মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খন্ডে বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণার সুযোগ পেয়ে যাবে।
বিরোধীদের এই অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গত শুক্রবার একই সঙ্গে তিন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত জম্মু–কাশ্মীরের ভোটের তফসিল ঘোষণা করা হলে মহারাষ্ট্রে বিজেপির জোট সরকার বিপাকে পড়ত। কারণ, ওই রাজ্যে শিবসেনা (শিন্ডে) বিজেপি ও এনসিপি (অজিত পাওয়ার) জোট সরকার এখনো ‘মুখ্যমন্ত্রী লড়কি বহিন’ প্রকল্পের প্রথম কিস্তির টাকাই বিলি করতে পারেনি।
নারীর ক্ষমতায়নে নগদ টাকা দেওয়ার এই প্রকল্প প্রথম চালু হয়েছিল কংগ্রেসশাসিত রাজস্থানে। পরে বিজেপিশাসিত মধ্য প্রদেশে এ প্রকল্প চালু হয়। দেখাদেখি মহারাষ্ট্রেও চালু করা হয় ওই প্রকল্প। বিজেপির জোট সরকার চাইছে অন্তত প্রথম কিস্তির টাকা বিলি করে ভোটে যেতে। সে জন্য কিছুদিন সময় তাদের দরকার। সেই সময় দিতেই হরিয়ানার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের ভোট করানো হচ্ছে না। অথচ পাঁচ বছর আগে এ দুই রাজ্যের ভোট একসঙ্গে হয়েছিল।
কেন এমন ছাড়া ছাড়া ভোট, সেই প্রশ্ন রাজীব কুমারকে শুনতে হয়েছিল। তিনি জম্মু–কাশ্মীরের নিরাপত্তার কারণ দেখিয়েছেন। মহারাষ্ট্রের বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখ করেছেন। বিরোধীরা সেই অজুহাত উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, যারা চার রাজ্যের ভোট একসঙ্গে করাতে পারে না, তারা আবার সারা দেশে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে করানোর পক্ষে কথা বলে! পুরোটাই বিজেপির রাজনীতি।
মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় লোকসভা ভোটে বিজেপি ও তার মিত্রশক্তি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঝাড়খন্ডেও তাদের আসন কমেছে। সে কারণে তারা এই রাজ্যগুলোয় একসঙ্গে ভোট পরিচালনায় আগ্রহী নয়।
শিবসেনার প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর অভিযোগ, বিজেপিকে পূর্ণ শক্তিতে প্রচারের সুবিধা করে দেওয়াই ইসির উদ্দেশ্য। কংগ্রেসের অভিযোগ, উপনির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি দুটি কারণে। ওয়েনাডে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদেরার জয় আরও কিছুদিন পিছিয়ে দেওয়া এবং উত্তর প্রদেশে বিজেপির আরও বেইজ্জতি হওয়া কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখা।
উত্তর প্রদেশে ১০টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন। সেগুলোর মধ্যে পাঁচটি সমাজবাদী পার্টির জেতা আসন। বিজেপির দুটি। বাকি তিনটি বিজেপির শরিকদের।
জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার ভোট শেষবার হয়েছিল ২০১৪ সালে। পিডিপি ও বিজেপি জোট বেঁধে সরকার গড়েছিল। ২০১৮ সালে বিজেপি সমর্থন প্রত্যাহার করলে পিডিপি–এনসি–কংগ্রেস বিকল্প সরকার গড়ার পথে এগোয়। তাদের সেই সুযোগ না দিয়ে রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয়। ২০১৯ সালে খারিজ করা হয় ৩৭০ অনুচ্ছেদ। রাজ্যও দ্বিখণ্ডিত হয়। সেই থেকে বিজেপি সুযোগ খুঁজে চলেছে, কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলের ক্ষমতা দখলের। সেই সুযোগ এবার তারা পাবে বলে মনে করছে।
এই ধারণার প্রধান কারণ, বিধানসভার আসন বৃদ্ধি ও বিধানসভা–লোকসভা কেন্দ্রগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণ। আগে বিধানসভার আসন ছিল ৮৭। লাদাখ আলাদা হওয়ায় তার চারটি আসন বাদ যায়। ফলে জম্মু–কাশ্মীরের আসন কমে হয় ৮৩। ডিলিমিটেশন কমিশন ৭টি আসন বাড়িয়ে মোট আসন (পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জন্য ২৪ আসন আলাদা রাখা হয়েছে) করে ৯০টি।
এসব আসনের মধ্যে জম্মুতে বাড়ানো হয় ছয়টি, কাশ্মীর উপত্যকায় একটি। জম্মুর আসন বেড়ে হয় ৪৩, কাশ্মীরের ৪৭। বিজেপির লক্ষ্য, জম্মুর সব আসনে জয় এবং সরকার গড়ার বাকি তিনটি আসন উপত্যকা থেকে জেতা। সেই লক্ষ্যে তারা নির্ভর করছে আপনি পার্টি ও আজাদ পার্টির ওপর। চেষ্টা চলছে, জামায়াত–ই–ইসলামির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের, যাতে তারা আপনি পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটে লড়তে পারে।
মুসলমানপ্রধান জম্মু–কাশ্মীরে কখনো কোনো হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী হয়নি। এনসি, পিডিপি ও কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনো দল ক্ষমতা দখলও করেনি। বিজেপি প্রথম সেই স্বাদ গ্রহণ করে পিডিপির সঙ্গে জোট বেঁধে। এবার তারা কোনো হিন্দুকে মুখ্যমন্ত্রী করতে পারলে সেটা হবে ইতিহাস।