খালিস্তান আন্দোলন ঘিরে ভারত-কানাডার সম্পর্ক তলানিতে
খালিস্তানি তৎপরতাকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডা সম্পর্কের আরও অবনতি হলো। চলতি বছরের জুনে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারত জড়িত, এমন অভিযোগ এনে সে দেশের এক কূটনীতিককে কানাডা গতকাল সোমবার বহিষ্কার করেছে। পাল্টা ভারতও আজ মঙ্গলবার বহিষ্কার করেছে দিল্লিতে নিযুক্ত কানাডার এক কূটনীতিককে। পাল্টাপাল্টি এই ব্যবস্থার ফলে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। কবে ও কীভাবে তা স্বাভাবিক হবে, এখনই বলা কঠিন।
হরদীপ সিং নিজ্জর কানাডায় বসবাসকারী শিখ নেতা। গত জুনে তিনি ভ্যাঙ্কুভারে এক গুরুদ্বারের কাছে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তিনি ভারতের পাঞ্জাবের জলন্ধর থেকে সে দেশে গিয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে। ভারতের অভিযোগ, হরদীপ সিং ছিলেন সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘খালিস্তানি টাইগার ফোর্স’ ও ভারতে নিষিদ্ধ ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর কানাডা শাখার নেতা। ভারতের চোখে তিনি অপরাধী ও ‘ফেরার’। তাঁকে দেশে ফেরত আনতে আগ্রহী ছিল ভারত।
হরদীপ সিং বরাবর স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র খালিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। ভারতের অভিযোগ, সেই লক্ষ্যে তিনি ভারতে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী হামলাও চালিয়েছেন। যদিও হরদীপ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ভারতের পর কানাডা হচ্ছে দ্বিতীয় দেশ, যেখানে শিখ সম্প্রদায়ের বসবাস সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক কারণেই সে দেশের রাজনীতিতে শিখ সম্প্রদায়ের প্রভাব যথেষ্ট। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে খালিস্তানিদের প্রভাব এবং তা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর দল কঠোর নন বলে ভারত অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে। এবার পাল্টা অভিযোগ এনে আসর গরম করলেন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো স্বয়ং।
গতকাল কানাডার পার্লামেন্টে ট্রুডো অভিযোগ করেন, হরদীপ সিংকে খুনের পেছনে ভারতের হাত থাকার নির্দিষ্ট প্রমাণ তাঁর সরকারের কাছে রয়েছে। তাঁদের কাছে সেই প্রমাণ যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যও। ট্রুডো বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরে কানাডার এক নাগরিককে এভাবে হত্যা করা, বিদেশিদের এমন প্রত্যক্ষ যোগসাজশ কানাডার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।
ওই অভিযোগের পরই কানাডায় অবস্থানরত এক ভারতীয় কূটনীতিককে বহিষ্কারের কথা জানান দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানিয়া জোলি। তবে কোন কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কানাডা তা জানায়নি। তবে মেলানিয়া জোলি এটুকু বলেন, যাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিক্যাল উইং’-এর (র) প্রধান ছিলেন।
আজ সকালেই কানাডার এই পদক্ষেপের কথা জানাজানি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে কানাডার সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বলেছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী সে দেশের পার্লামেন্টে যা বলেছেন, তা ‘অবাস্তব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। শুধু প্রতিবাদই নয়, ভারতে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার ক্যামেরুন ম্যাককে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ শুধু অসত্যই নয়, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর। সে দেশের এক শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের কথাও হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
পরে ভারতের মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে জানায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঁচ দিনের মধ্যে ভারত ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডার কূটনীতিকের অযথা হস্তক্ষেপ উদ্বেগজনক। তাঁদের ভারত বিরোধিতা বরদাশত করা যায় না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এই দেশে আইনের শাসন আছে। এই ধরনের অপ্রমাণিত অভিযোগের মূল লক্ষ্য খালিস্তানি চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদীদের দিক থেকে চোখ ফেরানো। এই জঙ্গিদের কানাডা আশ্রয় দিয়েছে। তারা ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। অথচ কানাডা সরকার নিষ্ক্রিয়। বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের।
ভারত-কানাডা সম্পর্ক যে মোটেই স্বাভাবিক নয়, তা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আসরে। ট্রুডো দিল্লি এসেছিলেন। আসার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কাঠামোগত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ভারত সেই বৈঠকে রাজি হয়নি। মোদি ও ট্রুডো সম্মেলনের অবসরে সামান্য কিছু সময়ের জন্য কথা বলেছিলেন। সেখানেও খালিস্তানিদের প্রতি নরম মনোভাব দেখানোর অভিযোগে ট্রুডোকে বিদ্ধ করেছিলেন মোদি।
বৈঠকে মোদি বলেছিলেন, কানাডায় ভারতীয় দূতাবাসে একাধিকবার খালিস্তানিরা হামলা চালিয়েছে। এই অভিযোগ তোলার পাশাপাশি বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, তা সত্ত্বেও কানাডার সরকার কারও বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। মোদি ভারতের অসন্তোষ ও অখুশির কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে বলেছিলেন, ভারতের আশা, কানাডা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ে শামিল হবে।
সেই বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে ট্রুডো বলেছিলেন, কানাডায় সবার চেতনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখানোর অধিকার আছে। যে অধিকারকে কানাডা বিশেষ গুরুত্ব দেয়, তা কখনো খর্ব করা যায় না। তবে সরকার হিংসা ও ঘৃণা বরদাশত করে না। ট্রুডো এ কথা জানাতে ভোলেননি যে হাতে গোনা কয়েকজনের অপকর্মের দায় একটা গোটা সম্প্রদায়ের ওপর চাপানো যায় না।
কানাডা-ভারত সম্পর্কের অবনতির রেশ বাণিজ্য আলোচনাতেও পড়েছে। দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত হয়ে গেছে। সম্প্রতি কানাডা বাণিজ্য মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্তও সাময়িকভাবে রদ করেছে। আগামী ৯ অক্টোবর ওই বাণিজ্য মিশনের ভারত সফরের কথা ছিল। এবার সরাসরি সে দেশের নাগরিক হত্যার দায় প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো চাপালেন ভারতের ওপর। গুরুতর এই অভিযোগের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও তলানিতে ঠেকেছে।