আম্বানির ছেলের বেহিসাবি বিয়ে নিয়ে কেন মানুষের ক্ষোভ, বিস্ময়
মুম্বাইয়ে ধুমধাম করে গত শুক্রবার সাত পাকে বাঁধা পড়লেন অনন্ত আম্বানি ও রাধিকা মার্চেন্ট। ভারতের ধনকুবের আম্বানি পরিবারের এ বিয়ে নিয়ে মানুষের মধ্যে ছিল না কৌতূহলের শেষ। বিবাহ–পূর্ব অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মূল আয়োজন—সবকিছুই নজর কেড়েছে। তবে অর্থের শ্রাদ্ধ আর জাঁকজমকে মোড়া এ বিয়ে নিয়ে আছে ঢের সমালোচনাও। কারও কারও মতে এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিয়ে।
মুকেশ ও নীতা আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত ও শিল্পপতি বীরেন মার্চেন্টের মেয়ে রাধিকার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চলছিল বেশ কয়েক মাস ধরেই। শেষমেশ মুম্বাইয়ের বান্দ্রা কুরলা কমপ্লেক্সের জিও ওয়ার্ল্ড সেন্টারে শুক্রবার রাতে মালাবদল করেন তাঁরা। অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পপতি–রাজনীতিবিদ—দেশি-বিদেশি বহু অতিথিই উপস্থিত ছিলেন এ দিনের অনুষ্ঠানে।
এ বিয়ে নিয়ে লোকজন যে ক্ষুব্ধ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু পোস্টে আপনি সেটি দেখতে পাবেন। বিয়ের প্রথা সমাজকে যেমন ঐক্যবদ্ধ করে, তেমন বিভক্তও করতে পারে। এ বিয়েতে অর্থসম্পদের যে প্রদর্শন হলো, সেটি কারও কারও মনে ক্ষোভ ও বিরক্তির জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের সেসব অনুভূতির ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে।রেখা কৃষ্ণান, কানাডার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
মুকেশ আম্বানির উত্তরসূরির এমন জৌলুশপূর্ণ বিয়ে ভারতবাসীকে রীতিমতো দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। বিশেষত, দেশটিতে ধনী–দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য আকাশ–পাতাল, আর তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
এশিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষটির ছেলের বিবাহ–পূর্ব অনুষ্ঠানগুলোর একটি ছিল গত মার্চে। তিন দিনের সেই আয়োজনে পারফরম্যান্স করেন পপ তারকা রিয়ান্না। আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় ছিলেন শত কোটিপতি বিল গেটস। ছিলেন মার্ক জাকারবার্গ। বাদ যাননি হলিউড–বলিউডের নামীদামি তারকা থেকে শুরু করে কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারও।
গত মে মাসে ছিল তিন দিনের আরেক অনুষ্ঠান। তাতে অংশ নেন কেটি পেরি, পিটবুল ও ডেভিড গেটা। গত ৫ জুলাই ছিল সংগীতজগতের তারকাসমৃদ্ধ অনুষ্ঠানও। সেখানে গান পরিবেশন করেন কানাডার জাস্টিন বিবার। এ জন্য তাঁকে ১ কোটি (১০ মিলিয়ন) ডলার সম্মানি দেওয়া হয় বলে শোনা যায়।
‘ভারতের নতুন যুগের রাজা–রানি’
নিউ লাইনস ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সম্পাদক সুরভী গুপ্ত সিবিসিকে বলেন, ‘এ যেন (আম্বানি পরিবার) ভারতের নতুন যুগের রাজা–রানি।’ বলেন, ‘ভারতে বিয়ের আয়োজন কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁরা আমাদের কল্পনাকে বহু গুণে ছাপিয়ে গেছেন।’
অনন্ত–রাধিকার বিবাহ–পূর্ব অনুষ্ঠানগুলোর মতো শুক্রবারের মূল আয়োজনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে সবাইকে তা মুগ্ধ করেনি।
ভারত এমন এক দেশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ আয়বৈষম্যের দেশগুলোর অন্যতম। আম্বানিরা দেশের দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জন্য যথেষ্ট অর্থ খরচ করেন না বলে সামাজিক মাধ্যমে এখন সমালোচনায় মুখর অনেকে। আম্বানির ছেলের বেহিসাবি বিয়ের আয়োজন মানুষের মধ্যে একদিকে যেমন বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে, তেমন ক্ষোভও সৃষ্টি করেছে অনেকের।
এটা (ভারতে ধুমধাম করে বিয়ে) সংস্কৃতির অংশ। আম্বানিরা বিবাহ-পূর্ব অনুষ্ঠান দীর্ঘায়িত করাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অনুষ্ঠানের খাবার, ফ্যাশন ও অলংকার–সাজসজ্জায়ও এনেছেন ভিন্নমাত্রা।সুরভী গুপ্ত, নিউ লাইনস ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সম্পাদক
কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রেখা কৃষ্ণান। তাঁর কথায়, ‘এ বিয়ে নিয়ে লোকজন যে ক্ষুব্ধ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু পোস্টে আপনি সেটি দেখতে পাবেন।’
রেখা কৃষ্ণান বলেন, ‘বিয়ের প্রথাগুলো সমাজকে যেমন ঐক্যবদ্ধ করে, তেমন বিভক্তও করতে পারে। এ বিয়েতে অর্থসম্পদের যে প্রদর্শন হলো, সেটি কারও কারও মনে ক্ষোভ ও বিরক্তির জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের সেসব অনুভূতির ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে।’
‘এমনকি, যে সমাজে জাঁকালো বিয়ের অনুষ্ঠানের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে, সেখানেও এমন আয়োজন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে’, বলেন অধ্যাপক রেখা।
আম্বানির ছেলের বিয়েতে কত খরচ
বিবিসির বরাত দিয়ে সিএনবিসি জানায়, রিলায়্যান্স শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলের বিয়েতে আনুমানিক ১১ বিলিয়ন থেকে ১৩ বিলিয়ন (১ হাজার ১০০ কোটি থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি) রুপি খরচ হয়েছে। যদিও এ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কেউ এ বিষয়ে কোনো অঙ্কের কথা প্রকাশ করেননি।
কারিশমা মানবানি লন্ডনে বিলাসী বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের একজন পরিকল্পনাকারী। ধনী পরিবারের বিয়ে নিয়ে কাজ করে থাকেন তিনি। সিএনবিসিকে কারিশমা বলেন, তাঁর মক্কেলরা বিয়েতে সাধারণত ২ লাখ ডলার থেকে ১০ লাখ ডলার খরচ করেন।
অন্যদিকে, অনুষ্ঠান ও বিয়ের পরিকল্পনায় সহায়তাকারী কোম্পানি প্রিস্টাইন ইভেন্টসের প্রতিষ্ঠাতা প্রিয়া সুগলানি সিএনবিসিকে বলেন, তাঁর মক্কেলরা বিয়েতে গড়পড়তা খরচ করেন ৪০ হাজার ডলার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
মুকেশ আম্বানির উত্তরসূরির এমন জৌলুশপূর্ণ বিয়ে ভারতবাসীকে রীতিমতো দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। বিশেষত, দেশটিতে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল, আর তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
মুকেশ আম্বানির সম্পদ ও ভারতে বিয়ের হালচাল
বর অনন্তর বাবা মুকেশ আম্বানি এশিয়ার শীর্ষ ধনী। বিখ্যাত সাময়িকী ফোর্বসের হিসাবে তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ ১২২ দশমিক ৬ বিলিয়ন (১২ হাজার ২৬০ কোটি) মার্কিন ডলার। টাকার হিসাবে যা ১৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬০০ কোটি (১ ডলার=১১০ টাকা হিসাবে)।
মুকেশ আম্বানির বড় ছেলে আকাশ আম্বানি (৩২) পারিবারিক টেলিকম ব্যবসা রিলায়্যান্স জিওর প্রধান। তাঁর জমজ বোন ইশা আম্বানি (৩২) পারিবারিক খুচরা ব্যবসা দেখাশোনা করেন। আর তাঁদের ছোট ভাই অনন্ত (২৯) নিজেদের জ্বালানি খাতের ব্যবসার দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন।
এদিকে, ভোগের তথ্য অনুযায়ী, অনন্তর নববধূ রাধিকা (২৯) শত কোটিপতি ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসায়ী বীরেন মার্চেন্টের মেয়ে। তিনি বাবার প্রতিষ্ঠান এনকোর হেলথকেয়ারের বিপণন পরিচালক।
ভারতে একজন দম্পতি সারা জীবন যে উপার্জন করে থাকেন, বিয়েতে গড়পড়তা সেই আয়ের এক–পঞ্চমাংশ খরচ করেন তাঁরা। সে হিসাবে আম্বানিরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের ধারাবাহিক অনুষ্ঠানে বলতে গেলে ভগ্নাংশ খরচ করছেন। যদিও এ খরচও দেশটির বেশির ভাগ মানুষের স্বপ্নের বাইরে।
আম্বানির সমালোচকেরা বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান মূলত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে উঠেছে। ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘যোগসাজশের পুঁজিবাদী’ ব্যবস্থা ভারতে তাঁর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করছে।
বিয়েতে অনুরাগী, বিদ্বেষী সবার নজর
নিউ লাইনস ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়ার সম্পাদক সুরভী গুপ্ত বলেন, কেউ বিয়ের জমকালো আয়োজন পছন্দ করতে পারেন, আবার কেউ পারেন ঘৃণা করতে। তবে বিয়েতে তাঁদের সবারই নজর আছে। তাঁরা এতে খরচও করছেন।
সুরভী গুপ্ত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাইরের লোকজন যাঁরা এমন আয়োজন অযথা বলে ভাবেন, তাঁরা ভারতে ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের মর্ম না বুঝতে পারেন। দেশটিতে বিয়ের আয়োজন কারও সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা ইঙ্গিত করে।
ধুমধাম করে ভারতে বিয়ের আয়োজনে উৎসাহও জুগিয়ে থাকেন অনেকে। সুরভী গুপ্ত বলেন, ‘এটা সংস্কৃতির অংশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আম্বানিরা বিবাহ–পূর্ব অনুষ্ঠান দীর্ঘায়িত করাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অনুষ্ঠানের খাবার, ফ্যাশন ও অলংকার–সাজসজ্জায়ও এনেছেন ভিন্নমাত্রা।’
ভ্যানিটি ফেয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ফ্যাশন সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, আম্বানি পরিবারের এমন বিয়ে ফ্যাশন জগতে ‘আগামী কয়েক দশকের’ নতুন ধারা গড়ে দেবে।