বিজেপি ঠেকাতে জম্মু-কাশ্মীরে বৃহৎ জোট করার চেষ্টায় কংগ্রেস
জম্মু–কাশ্মীরের ক্ষমতা দখলে বিজেপিবিরোধী শক্তি যতটা তৎপর, ততটাই জোর কদমে আসরে নেমে পড়েছে বিজেপি। বিজেপির লক্ষ্য, মুসলমানপ্রধান এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে প্রথম হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী উপহার দেওয়া। বিজেপিবিরোধী শিবির চায়, ক্ষমতা দখলে রেখে জম্মু–কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা আদায় করা।
এই লক্ষ্যে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ও রাহুল গান্ধী যেমন উপত্যকায় এসেছেন, তেমনই জম্মু গিয়েছেন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রামমাধব। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব ফের রামমাধবকে জম্মু–কাশ্মীরের দায়িত্ব দিয়েছে। গত মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কিষান রেড্ডিকে বিজেপি ওই দায়িত্ব দিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শ্রীনগরে দলীয় নেতা–কর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন খাড়গে ও রাহুল। কথা আছে, তাঁরা ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও সিপিএমের নেতাদের সঙ্গেও সম্ভাব্য জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনা করবেন।
দলীয় এক সূত্রের কথায়, পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতির সঙ্গে আলোচনা হবে কি না, তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলেই খাড়গে ও রাহুল যাবেন জম্মু। সেখানেও অনুরূপ বৈঠক সেরে তাঁরা দিল্লি ফিরবেন।
একইভাবে আজ বৃহস্পতিবার জম্মুতে প্রার্থী বাছাই নিয়ে বৈঠকে বসছেন রামমাধব। জম্মুর ১০ জেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার পর রামমাধব যাবেন শ্রীনগর। উপত্যকার ১০টি জেলার বিধানসভা ভোটে তারা কত আসনে প্রার্থী দেবে, এখনো নিশ্চিত নয়।
বিগত লোকসভা ভোটে বিজেপি উপত্যকায় প্রার্থী দেয়নি। তারা তাদের মদদে তৈরি আপনি পার্টি ও আজাদ পার্টিকে সমর্থন করেছিল। তবে তারা সফল হয়নি। লাদাখের একমাত্র লোকসভা কেন্দ্রেও বিজেপি হেরে যায় বিক্ষুব্ধ এনসি প্রার্থীর কাছে।
সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর উপত্যকার সব বিজেপিবিরোধী দল জোটবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছিল ‘গুপকর অ্যালায়েন্স’। সেই জোটে এনসি, পিডিপি, কংগ্রেস ও সিপিএম ছিল। পিপলস কনফারেন্সের সাজ্জাদ লোনও ছিলেন। পরে যদিও তিনি জোট ত্যাগ করেন।
লোকসভা ভোটের সময় ‘গুপকর অ্যালায়েন্স’ কিন্তু জোটবদ্ধ হয়ে লড়তে পারেনি। আসন ভাগাভাগি নিয়ে এনসি ও পিডিপির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিলে দুই দল আলাদাভাবে লড়েছে। এনসির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় কংগ্রেস। এনসির সমর্থন নিয়ে কংগ্রেস লড়েছিল জম্মু ও উধমপুর আসনে। দুটিতেই তারা হারে।
কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে উপত্যকায় তিন আসনে এনসি লড়লেও জয়ী হয় দুটিতে। ওমর আবদুল্লাহ হেরে যান অনন্তনাগ–রাজৌরি আসনে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ইঞ্জিনিয়ার রশিদের কাছে।
রাহুল গান্ধী চাইছেন ওই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে উপত্যকার সব বিজেপিবিরোধী দলকে একজোট করতে, যাতে বিজেপি ও তার সমর্থনপুষ্ট দলগুলো একটাও আসন না জেতে। রাহুলের এই চাহিদা বাস্তবায়িত হবে কি না, তা এই সফরেই বোঝা যাবে।
কিছুদিন আগে এনসি নেতা ফারুক আবদুল্লাহ এককভাবে লড়ার অভিপ্রায় জানিয়ে বলেছিলেন, জোটের প্রশ্ন বিবেচিত হবে ভোটের ফল প্রকাশের পর। পরে তিনি মত বদলান বলে খবর।
এনসি–কংগ্রেস আসন সমঝোতা উজ্জ্বল হলেও উপত্যকার ৪৭টি আসনের প্রতিটিতে বিজেপিবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে আসন সমঝোতা ও নির্বাচনী বোঝাপড়া সম্ভব হবে কি না, তা বোঝা যাবে খাড়গে ও রাহুলের এই সফর থেকে। পিডিপি জোটে শামিল না হলে মুসলমান ভোট ভাগাভাগি হবে। তাতে বিজেপির সুবিধা।
রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর কেন্দ্র পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়ে জম্মু ও উপত্যকার বিধানসভার আসনসংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে। দুই অঞ্চলের ২০টি জেলায় এখন মোট আসন বেড়ে হয়েছে ৯০। এর মধ্যে জম্মু এলাকার আসন ৩৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩, কাশ্মীর উপত্যকার আসন একটি বেড়ে হয়েছে ৪৭। এর অর্থ, আগে হিন্দুপ্রধান জম্মুর সঙ্গে মুসলমানপ্রধান কাশ্মীর উপত্যকার মধ্যে বিধানসভা আসনের তারতম্য যেখানে ছিল ৯টি (জম্মুর ৩৭, উপত্যকার ৪৬), এখন তা কমে হয়েছে মাত্র ৪।
বিজেপি চাইছে, হিন্দুপ্রধান জম্মুর ৪৩টি আসনের প্রতিটি জিততে। সে ক্ষেত্রে তারা সাহায্য পেতে চাইছে পাহাড়ি এলাকার মুসলমান জনতার কাছ থেকে, যাদের মধ্যে গুলাম নবী আজাদ ও আপনি পার্টির আলতাফ বুখারির কিছু প্রভাব রয়েছে। বিজেপির লক্ষ্য সরকার গঠনের ‘ম্যাজিক ফিগার’ ৪৬ আসনে পৌঁছাতে উপত্যকা থেকে তিন–চারটি আসন জেতা।
রাহুল মনে করেন, বিজেপির এই লক্ষ্যপূরণের পথে বাধা দেওয়া সম্ভব সব সমভাবাপন্ন শক্তি একজোট হলে। দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের তিনি বলেছেন, এনসি–পিডিপি জোটবদ্ধ হতে পারলে লোকসভা ভোটের ফল এমন হতো না।
খাড়গে–রাহুল জম্মু–কাশ্মীরে যাওয়ার সময় কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কে সি বেনুগোপাল বলেন, ‘বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে যা যা করা প্রয়োজন, কংগ্রেস তা করবে।’ একই কথা অন্যভাবে বলেছেন জম্মু–কাশ্মীরের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তারিক হামিদ, ‘বিজেপিকে রুখতে কংগ্রেসের দরজা সবার জন্য খোলা।’
জম্মু–কাশ্মীরে বিরোধীরা যে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হবে, বিজেপি তা জানে। সেটা যাতে না হয়, সে জন্য পাঁচ বছর সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা রামমাধবকে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব আবার দায়িত্ব দিয়েছে।
২০১৯ সাল পর্যন্ত রামমাধবের ওপরেই ছিল জম্মু–কাশ্মীর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব। সেই বছর লোকসভা নির্বাচনের পর রামমাধবকে সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে জম্মু–কাশ্মীর সামাল দেওয়া যাবে না, সেই উপলব্ধি হওয়ায় ভোটের আগে আবার তাঁকে দায়িত্বে আনা হয়েছে।
সেই সঙ্গে চেষ্টা চলছে উপত্যকার নিষিদ্ধ জামায়াত–ই–ইসলামিকে আসরে নামানো। পাঁচ বছর ধরে এই সংগঠন নিষিদ্ধ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ধারণা, জামায়াত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হলে এবং তার সঙ্গে আপনি পার্টি জোট বাঁধলে উপত্যকায় কিছু আসন জেতা সম্ভব হবে।
আপনি পার্টির আলতাফ বুখারির মধ্যস্থতায় জামায়াত নেতারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। তা ফলপ্রসূ হচ্ছে কি না, বোঝা যাবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে। যদিও বিজেপির একাংশের ধারণা, এই ছক ভবিষ্যতে সর্বনাশের কারণ হতে পারে।
জম্মু–কাশ্মীরের সম্ভাব্য ভোটচিত্র কেমন হতে চলেছে, খাড়গে–রাহুল–রামমাধবের সফরের মধ্য দিয়েই সেই রূপরেখা স্পষ্ট হবে। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রথম পর্যায়ের বিধানসভার ভোট ১৮ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট ২৫ সেপ্টেম্বর, তৃতীয় পর্যায়ের ভোট ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। ফল প্রকাশ ৪ অক্টোবর।