এক ভয়ংকর সমস্যার সঙ্গে লড়ছে কাশ্মীর
গত মে মাসের এক বৃষ্টিস্নাত সকাল। ভারতশাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরের একটি মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কিছু তরুণ। এই দলে কিশোরও আছে, যাদের সঙ্গে মা–বাবাদেরও দেখা গেল।
ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস কাশ্মীর নামের এই কেন্দ্র থেকে চিকিৎসকের মাধ্যমে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধপত্র পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন এই তরুণ-কিশোরেরা।
হাসপাতালে এক চিকিৎসক এক তরুণের চোখ পরীক্ষা করলেন। তারপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি আবার হেরোইন নিয়েছ?’ জবাবে তরুণ বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।’
সংঘাত-অস্থিরতায় কয়েক দশক ধরে কাশ্মীরের জীবনব্যবস্থা বিপর্যস্ত। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীরের পূর্ণ মালিকানা দাবি করে। এমনকি কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশ দুটি যুদ্ধে পর্যন্ত জড়িয়েছে।
১৯৮৯ সাল থেকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দেশটির কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ সশস্ত্র আন্দোলন চলে আসছে। একে কেন্দ্র করে হাজারো মানুষের প্রাণ গেছে।
২০১৯ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয়। একে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। এই পদক্ষেপে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা আরও বাড়ে।
এখন অঞ্চলটি আরেকটি নতুন সংকটে। সেখানকার কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকাসক্তি কাশ্মীরের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাশ্মীরি তরুণদের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে সর্বব্যাপী মাদক।
গত মার্চে ভারতের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেশটির সংসদে বলেছিলেন, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রায় ১০ লাখ মানুষ গাঁজা, আফিমসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক নেয়। এই সংখ্যা অঞ্চলটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪ শতাংশ।
এই তথ্যের সঙ্গে তুলনা করার মতো কোনো পরিসংখ্যান হাতে না থাকলেও স্থানীয় চিকিৎসকেরা বলছেন, কাশ্মীরে মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে।
ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেসের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক ইয়াসির রাথার বলেন, এক দশক আগেও তাঁরা এই হাসপাতালে দিনে ১০ থেকে ১৫ রোগী দেখতেন। কিন্তু এখন তাঁরা দিনে ১৫০ থেকে ২০০ রোগী দেখেন। এটি উদ্বেগজনক।
কাশ্মীরে মাদকসেবীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে কর্মসংস্থানের অভাব। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসের ফলে সৃষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিষয়টিরও এখানে দায় আছে।
কাশ্মীরের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা নানা সময় সংবাদ সম্মেলনে আসেন। তাঁরা বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দের তথ্য জানান। এই জব্দ মাদকের সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তানের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছেন।
কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মাদক চোরাচালানের অর্থ কাশ্মীরে জঙ্গিবাদের অর্থায়নে ব্যবহৃত হয়। তবে এই অভিযোগের বিষয়ে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
কিন্তু স্থানীয় কিছু মাদক ব্যবসায়ী বিবিসিকে বলেন, তাঁরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকেও মাদকের চালান পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি যেমন আছে, তেমন আছে পাঞ্জাবও।
অঞ্চলটিতে মাদকের অপব্যবহার নতুন কোনো সমস্যা নয়। তবে চিকিৎসক ইয়াসির বলেন, আগে এখানকার (কাশ্মীর) লোকজন গাঁজা বা অন্যান্য মাদক গ্রহণ করত। আগে এখানে হেরোইনের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু এখন তা দেখা যাচ্ছে।
গত বছর জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কাশ্মীরের ৫২ হাজারের বেশি মানুষ হেরোইন ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছেন।
সমীক্ষা অনুযায়ী, একজন মাদক ব্যবহারকারী এই হেরোইন পেতে মাসে গড়ে প্রায় ৮৮ হাজার রুপি খরচ করেন।
সমীক্ষায় যে তথ্য উঠে এসেছে, বাস্তবে কাশ্মীরে হেরোইন ব্যবহারকারীর সংখ্যা তার চেয়ে বেশি হতে পারে। কারণ, অনেকে এই আসক্তির কথা স্বীকার না–ও করে থাকতে পারেন। আবার সামাজিক কারণে অনেকে চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রে নাও যেতে পারেন।
কাশ্মীরের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পরিচালক চিকিৎসক মুশতাক আহমেদ রাথার বলেন, এই সমস্যার ব্যাপকতা সরকার বুঝতে পেরেছে। তাই সমস্যা মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
তবে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অঞ্চলটিতে আরও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি। যাতে এসব কেন্দ্রে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ভর্তি করা যায়, তারা এখানে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা পেতে পারে।
অঞ্চলটিতে সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে মাত্র দুটি। দুটি কেন্দ্রই শ্রীনগরে অবস্থিত। এর একটি ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস। অন্যটি পরিচালনা করে পুলিশ। অঞ্চলটিতে কয়েকটি বেসরকারি মাদকাসক্তি চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে।
মুশতাক আহমেদ বলেন, সরকার প্রতিটি জেলায় মাদকাসক্তি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র (এটিএফসি) স্থাপন করেছে। কিন্তু এগুলোতে পুনর্বাসন কেন্দ্রের মতো সুযোগ-সুবিধা নেই। এটিএফসি ছোট ক্লিনিক। এখানে একজন চিকিৎসক, একজন কাউন্সেলর ও একজন নার্স চিকিৎসাসেবা দেন। এই কেন্দ্রগুলো রোগীদের বিনা মূল্যে কাউন্সেলিং, চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে থাকে।
সরকারি ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেসে পুরো কাশ্মীর থেকে রোগী আসেন। ফলে এখানকার চিকিৎসকদের বিপুলসংখ্যক রোগী সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়।
ইনস্টিটিউটে তিন সপ্তাহ ধরে চিকিৎসাধীন ২৩ বছর বয়সী ড্যানিশ নাজির (ছদ্মনাম) বলেন, এটা এমন এক নেশা জাগানো বিষ, যা ব্যক্তিকে শেষ করে দেয়।
১৫ বছর বয়সী কিশোর এক রোগী বলে, সে তার বন্ধুদের খপ্পরে পড়ে মাদক নেওয়া শুরু করে। এগুলো কাশ্মীরে সহজেই পাওয়া যায়।
কয়েকজন সমাজকর্মী বলেন, মাদকের সরবরাহব্যবস্থা ধ্বংস করার প্রাথমিক দায়িত্ব সরকারের। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় পুলিশের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, মাদকের অপব্যবহার মোকাবিলায় সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে।