ভারতের ওডিশা রাজ্যের বাসিন্দা অশোক সামাল। থাকেন বালাসোর জেলার বাহাঙ্গাবাজার গ্রামে। আর দশ দিনের মতোই গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রেললাইনের কাছ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ বিকট শব্দ। রেললাইন ধরে দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন বীভৎস এক দৃশ্য। দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে ট্রেনের একাধিক বগি।
শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়েছিলেন বাহাঙ্গাবাজার গ্রামের আরও অনেকে। অশোক তাঁদেরই একজন। তিনি বললেন, ‘সেখান থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সব জায়গায় ছিল রক্ত। বগির মধ্যে আটকে পড়া লোকজন সাহায্য চাইছিলেন। দেখলাম, উল্টে যাওয়া অনেক বগির নিচেও মানুষ চাপা পড়েছে।’
গতকাল সন্ধ্যায় বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। ভারতের রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কলকাতাগামী বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেন বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছিল। কলকাতা থেকে চেন্নাইগামী করমন্ডল এক্সপ্রেস ওই এলাকা পেরিয়ে যাওয়ার সময় লাইনচ্যুত ট্রেনের বগির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। করমন্ডল এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি ঘটনাস্থলে একটি মালবাহী ট্রেনের বগির ওপরও আছড়ে পড়ে।
দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২০৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত ৯০০ জনের বেশি। এখনো অনেকে ট্রেনের ভেতরে আটকা পড়ে আছেন। তাঁদের উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ভারতের জরুরি সেবাকর্মীরা। হাত লাগিয়েছেন স্থানীয় লোকজনও। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দুর্ঘটনাকবলিত করমন্ডল এক্সপ্রেসের বগি থেকে যাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের একজন গোবিন্দ মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ ট্রেনটি ধাক্কা খেল। আমি যে বগিতে ছিলাম, সেটি তীব্র গতিতে লাইনচ্যুত হয়ে গেল। এরপর সেটি মাটির ওপর দিয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে থামল।’
এ সময় গোবিন্দ দেখতে পান বগিতে তাঁর পাশের জানালার শিক ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, ‘কেউ একজন জানালার শিক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আর আমরা বাইরে বের হয়ে এলাম।’ গোবিন্দ যে বগিতে ছিলেন, সেটির বেশির ভাগ যাত্রীকে উদ্ধার করেছেন অশোক সামালের মতো স্থানীয় লোকজনেরাই। দুর্ঘটনার পর তাঁরাই প্রথম সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন।
অনেক যাত্রীই এখনো বগির মধ্যে আটকে আছেন বলে জানালেন গোবিন্দ, ‘আমি দেখেছি, কয়েকজন বগির ভেতরে আটকে পড়ে সাহায্য চাইছেন। একজন বলছিলেন, তাঁর বুকে ব্যথা হচ্ছে।’
করমন্ডল এক্সপ্রেসে করে গতকাল অনেক অভিবাসীশ্রমিক পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে যাচ্ছিলেন বলে জানিয়েছেন ওডিশার এক পুলিশ কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনে খবর পেয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার থানাগুলোতে যোগাযোগ করেছে এসব শ্রমিকের অনেকের পরিবার।’
এদিকে কলকাতাগামী বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীরাও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। এই ট্রেনটিতেই ধাক্কা দেয় করমন্ডল এক্সপ্রেস। বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের যাত্রী শুভংকর রুইদাস বলেন, ‘আমাদের ট্রেনটির সঙ্গে যখন করমন্ডল এক্সপ্রেসের ধাক্কা লাগে, তখন মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। আমার বগিতে তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। আমরা ট্রেনের ভেতরেই বসে ছিলাম। দেখছিলাম, উদ্ধারকারীরা করমন্ডল এক্সপ্রেসের আহত যাত্রীদের সাহায্য করছেন।’
গতকালের রেল দুর্ঘটনাটিকে ভারতে গত বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বছর দশেক আগে ২০১৩ সালে করমন্ডল এক্সপ্রেসের ওডিশার জাজপুর জেলায় দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। এবারের দুর্ঘটনাস্থল থেকে সেটি ছিল মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে।