ভারতে ভোটের রাজনীতি রহস্যময় থেকে গেল

দেখতে দেখতে আরেকটি বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন, মূল্যস্ফীতি আর যুদ্ধের বছর ছিল ২০২৪। এ বছর বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া বিশেষ বিশেষ ঘটনা নিয়ে পাঠকদের জন্য আমাদের বিশেষ আয়োজন।

নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধীছবি: এএফপি

বিদায়ী বছরের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় রাজনীতির দিকে তাকালে রোলার কোস্টারের ছবি ভেসে উঠতে পারে। এত ওঠানামা, এত জল্পনা, আশা ও আশাভঙ্গের এমন দ্যোতনা এবং অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ঘিরে প্রবল সন্দেহজনিত ক্ষোভ ও অভিযোগ আগে খুব একটা দেখা যায়নি। বলতেই হবে, ভারতের রাজনীতি এত বর্ণিল অদূর অতীতে ছিল না।

চলতি বছর বিদায়ের আগে রাজনৈতিক প্রবাহের দিকে নজর দিলে পরিবর্তনের ওঠানামার চরিত্র বোঝা সহজ হবে। গত বছরের মে মাসে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক বিধানসভার নির্বাচনের ছবিটা একটু মনে করুন। সেখানে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে দিয়েছিল কংগ্রেস। নরেন্দ্র মোদির শত চেষ্টা সত্ত্বেও কর্ণাটকে বিজেপি গোহারা হেরেছিল। বিজেপির সেই হার ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল হতোদ্যম, পর্যুদস্ত, বিমর্ষ কংগ্রেসের চনমন করে ওঠা। কর্ণাটক জয় ছিল কংগ্রেসের কাছে কোরামিনতুল্য।

হারতে হারতে হীনম্মন্যতার প্রতীক হয়ে ওঠা শতাব্দীপ্রাচীন দল কংগ্রেসের মধ্যে কর্ণাটক জয় বিশ্বাসের একটা বীজ বপন করেছিল। সেই ঢেউ ধাক্কা দিয়েছিল আরেক দক্ষিণি রাজ্য তেলেঙ্গানায়ও। বিআরএস ও বিজেপির মোকাবিলা করে সেখানেও কংগ্রেস উড়িয়েছিল জয়ধ্বজা।

তখন মনে করা হচ্ছিল, কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীরের শ্রীনগর পর্যন্ত রাহুল গান্ধীর ৪ হাজার কিলোমিটার ভারত জোড়ো যাত্রা ভাঙাচোরা কংগ্রেসকে জোড়া লাগিয়ে দেশজ রাজনীতির চালচিত্র হয়তো নতুন রঙে রাঙাতে চলেছে।

চনমনে কংগ্রেসিরা যখন মোদিকে নাস্তানাবুদ করে নতুনভাবে মাথা তোলার স্বপ্নজাল বুনতে শুরু করেছে, কোমরভাঙা ধাক্কাটা তখন দেয় মোদির বিজেপিই। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে সব হিসাব গুলিয়ে কংগ্রেসের গরিমা ধুলায় মিশিয়ে দেয় তারা। মধ্যভারতে নিজেদের আধিপত্য নতুন করে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গালিভাররূপী কংগ্রেসকে তারা লিলিপুটে রূপান্তরিত করে এক মহাবিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল!

হারা ম্যাচ কীভাবে জিততে হয়, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপি তা দেখিয়ে দেয়। বছর শেষের ওই জয় বিজেপির কাছে যতটা কাম্য ছিল, ততটা তাগিদ কংগ্রেসেরও ছিল পায়ের তলার মাটি শক্ত করার জন্য। মনে রাখতে হবে, তত দিনে বিরোধীরা ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরি করে ফেলেছে। লোকসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার স্বপ্ন দেখাও শুরু করেছে।

২০২৪ সাল ভারত দুই ধরনের রাজনৈতিক আবহ মেলে ধরে। একদিকে বিজেপি, অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ। কর্ণাটক হারানোর ধাক্কা সামলে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থান জয়ের পর বিজেপি তার উঁচু মাথা কিছুটা নত করে পুরোনো জোট এনডিএকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ১০টা বছর যাদের তারা কোনোরকম কল্কে দেয়নি, তাদের কাছে টেনে শিথিলতা ঝেড়ে ফেলে নতুন করে জমাট বাঁধতে থাকে। মোদির মোকাবিলায় বিরোধী জোট গড়া হলেও ‘ইন্ডিয়া’ জোটে তখন নানা টানাপোড়েন ফুট কাটছে।

সন্দেহ নেই, প্রাথমিকভাবে ‘ইন্ডিয়া’ জোট বিজেপিকে কিছুটা হকচকিত করে তুলেছিল। সেখান থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে নতুন বছরের গোড়াতেই ইন্ডিয়ায় ভাঙন ধরায় বিজেপি। নীতীশ কুমারকে তারা আরেকবার কাছে টেনে নেয়। এই ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’-এর পাশাপাশি তারা চেষ্টা চালায় বিরোধী জোটে কংগ্রেসের আধিপত্য খর্ব করার। রাজনৈতিকভাবে বিজেপির বিরোধিতা করলেও জোট রাজনীতিতে কংগ্রেসের আধিপত্য মানতে যাদের প্রবল আপত্তি, মোদি-শাহ জুটি চতুরভাবে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। কংগ্রেসকে রুখতে তৃণমূল কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে বিজেপির অলিখিত ও অনুচ্চারিত আঁতাতের কাহিনিও তাই পল্লবিত হয়। ওই দুই দলের কাছাকাছি চলে আসে আম আদমি পার্টিও (এএপি)।

‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক হয়েও নিজেদের খাসতালুকে কংগ্রেসের মাথাচাড়া দেওয়া ঠেকাতে এবং জোটের রাশ নিজেদের হাতে রাখতে এসব দল ও তাদের নেতারা ক্রমাগত এমন পদক্ষেপ নিতে থাকে, যা বিরোধী জোটের পক্ষে আদৌ সুখকর বিজ্ঞাপন ছিল না। জোট শরিকদের এই রাজনৈতিক প্রবণতা রুখতে যে প্রজ্ঞা, নমনীয়তা, বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন ছিল, দুঃখের বিষয়—কংগ্রেসের শীর্ষ ও আঞ্চলিক নেতৃত্ব তা দেখাতে পারেনি। তা সত্ত্বেও ২০২৪ সালের জুনের লোকসভা ভোট আপাতনিস্তরঙ্গ জাতীয় রাজনীতিতে নতুন আলোড়ন তোলে। বিজেপিকে বিরোধীরা নামিয়ে আনে ৩০৩ থেকে ২৪০ আসনে। কংগ্রেস ওঠে আসে ৫১ থেকে ৯৯ আসনে। নরেন্দ্র মোদিকে করে তোলে আরও বেশি করে শরিক নির্ভর। ১০ বছর পর এই প্রথমবার শরিকি ক্রাচে ভর দিয়ে সরকার গড়তে হয় তাঁকে।

টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে জওহরলাল নেহরুকে ছুঁয়ে ফেললেও লোকসভা ভোটের ফল মোদির বিজেপির পক্ষে আশানুরূপ না হওয়ার একাধিক কারণ ছিল। তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্রে বিরোধীদের মোকাবিলায় বিজেপি ব্যর্থ হয়েছে আঞ্চলিক কোন্দল ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে। মধ্য ও উত্তর ভারতে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, ঝাড়খন্ডে আরএসএসের সাহচর্য না মেলায় বিস্তর আসন তাদের খোয়াতে হয়।

লোকসভা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাজনীতিকে পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত করে তোলার মোদি-নীতি উত্তর প্রদেশে মুখ থুবড়ে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের অসহযোগিতার কারণে। যোগীর ডানা ছেঁটে মোদি-শাহর বিজয়রথ ছোটানোর বাসনা ও তত্ত্ব কতটা আত্মঘাতী ছিল, উত্তর প্রদেশের ফল মোদি-শাহ জুটির চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দেয়। সেটা ছিল তাঁদের কাছে অশনিসংকেত। ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ মোদি তাই সময় নেননি। যোগীকে তাঁর প্রাপ্য ছেড়ে দিতে গড়িমসি করেননি। বছর শেষে উত্তর প্রদেশের বিধানসভার উপনির্বাচনগুলোর ফল তার প্রমাণ।

লোকসভা ভোট কংগ্রেসের মরা গাঙে অবশ্যই কিছুটা বান এনেছিল। কিন্তু নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারেনি। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানের বিস্ময়কর এবং অপ্রত্যাশিত পরাজয় থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষাও নিতে পারেনি। পারেনি বলেই লোকসভা ভোটের রেশ পরবর্তীকালে বিধানসভার ভোটে ধরে রাখতে তারা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপির কৌশলে তারা নাস্তানাবুদ হয়। জম্মুতে বিজেপির মোকাবিলায় ফল ছিল হতাশাজনক।

জোট শরিক হিসেবে কংগ্রেসের মুখ ও মান বেঁচেছে ঝাড়খন্ডে। সেটাও হয়েছে বিজেপির রাজনৈতিক ভুলের জন্য। মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে জেলে ঢোকানোর খেসারত এভাবে দিতে হতে পারে, বিজেপির নীতিনির্ধারকেরা সম্ভবত তা কল্পনায়ও আনেননি। সেই ভুল রাজ্যের আদিবাসী সমাজকে এককাট্টা করে তুলেছিল। হেমন্তকে জিতিয়ে তারা তার প্রতিশোধ নিয়েছে।

আসনসংখ্যা না বাড়লেও জোট শরিক হিসেবে কংগ্রেসের মুখ বাঁচিয়েছে জম্মু-কাশ্মীরও। সেখানকার বিধানসভার ভোট বিজেপির কাছে শিক্ষণীয় হতে পারে। যদিও সেই শিক্ষা তাদের রাজনীতি বদলে দেবে, এমন মনে করা হবে গুরুতর ভুল। একদা রাজ্য এখন কেন্দ্রশাসিত এ অঞ্চলে ভোটে জিতে কোনো হিন্দুকে মুখ্যমন্ত্রী করার বাসনা বিজেপির বহুদিনের। সেই ইতিহাস রচনার তাগিদে তারা সব করেছে। মুসলমানপ্রধান কাশ্মীরের সঙ্গে হিন্দুপ্রধান জম্মুর আসনের ব্যবধান কমিয়েছে জম্মুর আসনসংখ্যা বেশি বাড়িয়ে। কেন্দ্রগুলোর সীমানা এমনভাবে আঁকা হয়েছে যাতে হিন্দু-মুসলমান ভোটের আনুপাতিক হার বিজেপির পক্ষে ফলদায়ী হয়। উপত্যকায় আসন জিততে তারা তাঁবেদার মুসলমান নেতাদের দল ভাঙিয়ে নতুন দল গড়তে সাহায্য করেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভোটে দাঁড়ানোর অনুমতি ও মদদ দিয়েছে। কিন্তু এত করেও কাশ্মীরে বিজেপি দাঁত ফোটাতে পারেনি। অবশ্য জম্মুতে তাদের আসন বেড়েছে।

জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি খুব দ্রুত বিজেপি স্বেচ্ছায় পালন করবে, এমন মনে করার কোনো কারণ এখনো ঘটেনি। প্রতিশ্রুতি পালনের অর্থ জম্মু-কাশ্মীর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাত গুটিয়ে নেওয়া। রাজ্যের সব ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দেওয়া। নতুন বছর প্রমাণ করবে, স্বেচ্ছায় রাজ্যের মর্যাদা ফেরাতে বিজেপি কতটা উৎসুক।

জম্মু-কাশ্মীরে সরকার গঠন করতে না পারা এবং ঝাড়খন্ডে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের হাতিয়ার করে জনবিন্যাস বদলের প্রচারের মুখ থুবড়ে পড়া বিজেপির ব্যর্থতা হলেও মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় সাফল্যের ঢক্কানিনাদে তা ঢাকা পড়ে গেছে। নির্বাচনী সাফল্যের সাতকাহন তারা অনুগত বশংবদ গোদি মিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমনভাবে উদ্‌যাপন করেছে, যাতে অন্যত্র বিজেপির নির্বাচনী ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে যায়। রোলার কোস্টারতুল্য রাজনীতির এই ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত ভারতীয় সমাজে সতীর সহমরণে যাওয়ার ছবি। স্বামীর প্রজ্বলিত চিতায় সহধর্মিণীর মৃত্যুবরণ কতটা স্বেচ্ছায়, কতটাই-বা জবরদস্তির দরুন, সেই তর্ক আবহমানকালের। সতীর আর্তনাদ ঢাকতে তাঁর নামে জয়ধ্বনি করা হতো। ঝাড়খন্ড ও জম্মু-কাশ্মীরের পরাজয় ঢাকতে বিজেপিও ঠিক তেমনভাবেই সক্রিয়।

কিন্তু সেই সক্রিয়তা ঢাকা দিতে পারেনি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ওঠা পক্ষপাতিত্বের ভূরি ভূরি অভিযোগ। ইভিএমের কারচুপি নিয়ে সন্দেহের নিরসনও বিজেপির জয়োল্লাস ঢাকতে পারেনি। বরং সংশয় ও সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে।

২০২৩ সালের শেষে মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় এবং ২০২৪ সালে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার ফল বিপুল বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। এই চার রাজ্যের নির্বাচনী হেঁয়ালির কিনারা আজও কোনো ব্যোমকেশ বক্সি, ফেলু মিত্তির বা শবর দাশগুপ্ত করে উঠতে পারেননি। ভোটার চরিত্র এত অল্প সময়ে কীভাবে এমন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে, সেই ব্যাখ্যাও কারও কাছে নেই। মাত্র পাঁচ মাসে ভোটারের হৃদয় বদলের এমন নজিরও সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। পরাজিতরা যেমন বিহ্বল ও হকচকিত, জয়ীরাও তেমনই হতবাক!

ফল ঘোষণার পর পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সমর্থকদের উল্লাস
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের ভোট নিয়ে যত সমীক্ষা হয়েছিল, তাতে কোথাও বিজেপির নিশ্চিত জয়ের ইঙ্গিত ছিল না। বরং প্রায় সবাই ওই দুই রাজ্যে কংগ্রেসের পক্ষে মত দিয়েছিল। অথচ দেখা গেল, দুই রাজ্য বিজেপি জিতল আগের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি ভোট বাড়িয়ে! এতে ভ্রুকুঞ্চিত হয়েছিল সবার। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে ‘ম্যাক্রো লেভেলে’ ভোট পরিচালনায় না গিয়ে বিজেপি কি ‘মাইক্রো পর্যায়ে’ ভোট লুটের বন্দোবস্ত পাকাপাকি করে ফেলল? উত্তর মেলেনি, যদিও সন্দেহ গেড়ে বসেছে।

নির্বাচন কমিশনের ঔদাসীন্য, ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া, শাসক দলের দাপাদাপি ও গণমাধ্যমের প্রচারে সবার সব ওজর আপত্তি ধামাচাপা পড়েছে। কিন্তু মূল প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। নিরসন হয়নি সন্দেহেরও।

সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায়। বিজেপি মহারাষ্ট্র জেতে লোকসভার তুলনায় ১৪ শতাংশ বেশি ভোট ও তিন-চতুর্থাংশ আসন পেয়ে। ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনো রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল কোনো ভোটে এমন দাপট দেখিয়ে জিততে পারেনি! বিস্ময় আরও এ কারণে যে মাত্র পাঁচ মাস আগে ওই রাজ্যে লোকসভা ভোটে মোদির ভাবমূর্তি ও জোটের চালচিত্র দুই-ই ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছিল।

ডবল ইঞ্জিনের মাহাত্ম্য প্রচার ও শিবসেনা-এনসিপি ভাঙিয়ে বিরোধীদের কমজোরি করা সত্ত্বেও তারা বিরোধীদের চেয়ে ১ শতাংশ ভোট ও ২৮টি আসন কম পেয়েছিল। মাত্র পাঁচ মাসে এমন কী ভোজবাজি ঘটে গেল, যাতে এত বড় এক রাজ্যের এতগুলো আসন শরৎ প্রাতে শিউলি ঝরার মতো শাসক জোটের কোলে ঝরে পড়ল? স্বর্গবাসী সেরা জাদুকর স্যার হুডিনিও এই ভোজবাজিতে নিশ্চিতই ভ্যাবাচেকা খাবেন।

মহারাষ্ট্রের সঙ্গে হরিয়ানার মিলও অবিশ্বাস্য। ১০ বছর ধরে সেখানে ক্ষমতাসীন বিজেপির প্রত্যাবর্তনের কোনো ইঙ্গিত প্রাক্‌-নির্বাচনী কোনো সমীক্ষা বা বুথফেরত জরিপে কেউ দেয়নি। সাংবাদিককুল, ভোটপণ্ডিতদের প্রত্যেকে নির্দ্বিধায় কংগ্রেসের জয় ঘোষণা করেছিলেন। যত সমীক্ষা হয়েছিল, ৯০ আসনের মধ্যে কংগ্রেসকে সবচেয়ে কম দেওয়া হয়েছিল ৫৫টি, সবচেয়ে বেশি ৭২।

কৃষক বিক্ষোভ, মহিলা কুস্তিগিরদের অসম্মান, ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের জন্য সেনা পরিবারের অসন্তোষে বিজেপি যেখানে জেরবার, গ্রামাঞ্চলে নেতারা প্রচার পর্যন্ত করতে পারেননি, কী আশ্চর্য, সেই হরিয়ানায় দেখা গেল তারা একাই ৪৮ আসনে জয়ী! কী করে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব, সেই জিজ্ঞাসার সদুত্তর আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ। আগামী বছরের শুরুতে দিল্লি বিধানসভার ভোট। অনুগত নির্বাচন কমিশন ও ইভিএম কী খেলা কীভাবে খেলে চলছে এবং আগামী দিনে কী খেলবে, কেউ তা জানে না। ২০২৪ সালের ভারতীয় রাজনীতি এ কারণেই এত রহস্যময়।