ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে সমানে সমান লড়াই
১৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনকে এক লাইনে ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়, লড়াই একেবারে সমানে সমান। সব প্রধান দলই একে অন্যের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে। এমন মনে করছেন সবাই—‘উবার’ কোম্পানির অটোচালক অভিজিৎ দাস থেকে জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক প্রদীপ দত্ত ভৌমিক বা তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতাত্ত্বিকের অধ্যাপক চন্দনকুমার শর্মা। তাঁদের মতে, প্রতিটি দলেরই জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রবল উৎসাহ নিয়ে প্রচারে সবাই।
রাস্তার প্রতিটি মোড়, যাকে আগরতলায় বলা হয় চৌমহনী, নিজেদের পতাকায় মুড়ে ফেলেছে প্রতিটি প্রধান দল।
রাজ্যে প্রধান দুই দল হলো ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং সাবেক ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট (সিপিআইএম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। এদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে কংগ্রেস, শহরে তাদের পতাকাও প্রচুর। আর তাৎপর্যপূর্ণভাবে জেতার তেমন সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও পতাকা, ফেস্টুন, পোস্টার, নেতা-নেত্রীদের কাটআউট লাগানোর প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। দলের দুই তারকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রিপুরা ঘুরে গিয়েছেন। গতকাল শুক্রবারও দুটি সভা করেন অভিষেক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসবেন রোববার। তারপরের দিন আবার অভিষেক। অর্থাৎ নির্বাচন সামনে রেখে ত্রিপুরা জমজমাট।
সাংবাদিক প্রদীপ দত্ত ভৌমিক অবশ্য বলেন, এই দৌড়ে তৃণমূল কংগ্রেস একেবারেই নেই। দৈনিক সংবাদ-এর দপ্তরে বসে তিনি বলেন, ‘সামান্য ভোট হয়তো তারা পাবে, কিন্তু তা-ও কত পাবে বা আদৌ পাবে কি না, সেটাও এখন বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। সবারই একেবারে ৫০-৫০ শতাংশ জেতার সম্ভাবনা।
এই ‘সবাই’-এর এক দিকে রয়েছে সিপিআইএম-কংগ্রেসের নির্বাচনী আঁতাত, যেখানে ৬০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস লড়ছে ১৩টিতে, আর বামফ্রন্ট ৪৭ আসনে। কংগ্রেসের এক স্থানীয় নেতা জানান, এই আসন সমঝোতা ‘একপেশে’। এতে তাঁরা খুশি না হলেও আগামী দিনে বৃহত্তর জাতীয় জোটের কথা মাথায় রেখে ত্রিপুরায় বামফ্রন্টকে বেশি আসন ছাড়তে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন।
অবশ্য কংগ্রেসের যে খুব বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, এমনটা তাদের নেতারা খুব জোর দিয়ে বলতে পারবেন না। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ২ শতাংশের কম ভোট পেয়েছিল এবং কোনো আসন পায়নি। বামফ্রন্ট সেখানে ৪২ শতাংশের ওপর ভোট পেয়েছিল। আসন পেয়েছিল ১৬টি। যদিও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বামফ্রন্টের থেকে বেশি ভোট পেয়েছিল। এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই তারা বেশি আসন চেয়েছিল, যা দিতে বামফ্রন্ট অস্বীকার করে।
অধ্যাপক চন্দনকুমার শর্মার বক্তব্য, কংগ্রেসের ভোট সামান্য। তবু সিপিআইএম ও কংগ্রেসের কাছাকাছি আসাটা একটা ইতিবাচক বার্তা দেয়, যা বিজেপির জন্য খুব ভালো খবর নয়। অধ্যাপক শর্মা বলেন, কংগ্রেসের সমর্থকেরা শেষ পর্যন্ত গিয়ে সিপিএমকে ভোট দেবেন কি না এবং উল্টো দিকে যেখানে বামফ্রন্টের প্রার্থী নেই, সেখানে বাম সমর্থকেরা কংগ্রেসকে ভোট দেবেন কি না, এটা একটা খুব বড় প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৬ সালে যখন বাম এবং কংগ্রেসের মধ্যে আঁতাত হয়েছিল, তখন কিন্তু কংগ্রেসের ভোট সিপিআইএমে যায়নি।
তবে বিজেপির জন্য তার চেয়ে অনেক বড় উদ্বেগ ত্রিপুরার মূল নিবাসী, উপজাতি মানুষের দল তিপ্রা মথার উঠে আসা। আগরতলার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে তিপ্রা মথার একটিও ব্যানার বা পোস্টার চোখে পড়ল না। কিন্তু বিজেপিকে যে প্রবল চিন্তায় রেখেছে ত্রিপুরার রাজা প্রদ্যুৎ দেববর্মনের এই নতুন দল, তা স্পষ্ট বোঝা যায় বিজেপির নেতাদের বক্তব্য থেকে। তাঁরা যতটা আক্রমণ করছেন সিপিআইএম বা কংগ্রেসকে, তার থেকে কোনো অংশে কম আক্রমণ করছেন না তিপ্রা মথাকে।
বিজেপির নেতাদের বক্তব্য, ত্রিপুরার মূল বাসিন্দাদের জন্য আলাদা এবং বৃহত্তর টিপ্রাল্যান্ড বা বৃহত্তর ত্রিপুরার যে স্বপ্ন রাজা সংবিধানের মধ্যে থেকে দেখাচ্ছেন, তা বাস্তবায়ন করার কোনো নির্দিষ্ট ও গঠনমূলক পরিকল্পনা তাঁর নেই।
বিজেপিকে বারবার প্রদ্যুৎ দেববর্মণ এবং তিপ্রা মথাকে যে আক্রমণ করতে হচ্ছে তার কারণ, ত্রিপুরায় ৬০ আসনের মধ্যে ২০টি আসনে মথার প্রবল প্রভাব রয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৃহত্তর টিপ্রাল্যান্ডের দাবিতে দল গঠন করার কয়েক মাসের মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে স্বশাসিত আদিবাসী পরিষদের নির্বাচনে জিতেছিল তিপ্রা মথা। এরপর গত দুই বছরে তারা বিজেপির আদিবাসী শরিক ইন্ডিজিনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরাকে (আইপিএফটি) প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আইপিএফটি সাড়ে ৭ শতাংশ ভোট এবং ৮টি আসন পেয়েছিল। এখন তাদের অধিকাংশ নেতা-কর্মী তিপ্রা মথায় যোগ দিয়েছেন।
সাংবাদিক প্রদীপ দত্ত ভৌমিক বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের বাইরেও এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেগুলো মিশ্র (যেখানে বাঙালি ও উপজাতি সমাজের মানুষ রয়েছেন), সেখানেও তিপ্রা মথার কিছু ভোট থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা অস্বস্তিতে রেখেছে বিজেপিকে।
এর সঙ্গে একটা সমস্যা যুক্ত হয়েছে বিজেপির, যার কথা বলছিলেন অভিজিৎ। অভিজিতের বক্তব্য, ‘আমরা সিপিআইএমের সময় দেখেছি আর কিছু হোক না হোক, প্রতিবছর তারা কিছু সরকারি চাকরি দিত। বাকি সব কাজ হয়তো কম-বেশি সিপিএম বা বিজেপি একই করেছে, কিন্তু সরকারি চাকরিটা ত্রিপুরার মতো ছোট জায়গায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় এবং এই জায়গায় বিজেপি আমার মনে হয় অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। এই কারণে মানুষ বেশ অসন্তুষ্ট।’ বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারেও কর্মহীনতা এবং চাকরির প্রতিশ্রুতির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি বলে অভিযোগ আগরতলার মানুষের।
শুক্রবার বিকেলে আগরতলা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে মাইকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রোববার ত্রিপুরা সফরে আসার কথা প্রচার করা হচ্ছে। তিনি এলে যে হাওয়া তৈরি হবে, তা বিরোধীদের পক্ষে সামলানো অসম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজেপির নেতা-নেত্রীরা।