তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে দিয়ে যথেচ্ছাচার দেশকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করেছে

রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, অখিলেশ যাদব, ভগবন্ত সিং মান
ছবি: এএনআই

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নতুন ভারতের ‘গণতন্ত্রহীনতা’ নিয়ে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছবি এঁকেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, হুবহু সেই অভিযোগে সরব হলেন দেশের ৮ বিরোধী দলের শীর্ষ ৯ নেতা। নরেন্দ্র মোদিকে এক চিঠিতে তাঁরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে দিয়ে যথেচ্ছাচার দেশকে গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করেছে।

আবগারি নীতিতে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার দিল্লির শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে এই ৯ নেতা চিঠিতে লিখেছেন, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে মুড়ি-মুড়কির মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ বিরোধী দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হয়ে যাচ্ছেন ‘ধোয়া তুলসীপাতা’। দেশ ক্রমেই হয়ে উঠছে স্বৈরতান্ত্রিক।

প্রধানমন্ত্রীকে গতকাল রোববার পাঠানো ওই চিঠিতে সই করেছেন চার মুখ্যমন্ত্রী—পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, পাঞ্জাবের ভগবন্ত সিং মান ও তেলেঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও। আরও আছেন বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর প্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের তিন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে ফারুক আবদুল্লাহ, অখিলেশ যাদব ও উদ্ধব ঠাকরে। সই করেছেন প্রবীণ এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারও।

বিরোধীরা আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, মহারাষ্ট্রের নারায়ণ রানে ও পশ্চিমবঙ্গের মুকল রায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর নাম উল্লেখ করে বলেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু দল বদলে বিজেপিতে যাওয়ার পর সব ধামাচাপা।

২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর কীভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে বিরোধীদের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই খতিয়ান তুলে ধরে তাঁরা বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কাজটা করা হচ্ছে ঠিক নির্বাচনের আগে। এ থেকে স্পষ্ট, মোদি সরকার বিরোধীদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। তাঁরা বলেন, সিসোদিয়াকে দীর্ঘ জেরার পর কোনো প্রমাণ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়। কী কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো, তার কারণও জানানো হয়নি।

বিরোধীরা আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, মহারাষ্ট্রের নারায়ণ রানে ও পশ্চিমবঙ্গের মুকুল রায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর নাম উল্লেখ করে বলেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু দল বদলে বিজেপিতে যাওয়ার পর সব ধামাচাপা। কংগ্রেস সভাপতি রাজ্যসভার বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এই বিষয়কে ‘ওয়াশিং মেশিন’ বলে বিজেপিকে কটাক্ষ করেছিলেন।

মাত্র কয়েক দিন আগে ইংল্যান্ড গিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে রাহুল গান্ধী মোদির ‘নতুন ভারতের’ এই অবস্থারই বর্ণনা দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে ওই সভায় রাহুল বলেছিলেন, একজন ভারতীয় জননেতা কেমব্রিজ বা হার্ভাডে গিয়ে খোলামেলা মতবিনিময় করতে পারেন, কিন্তু নিজের দেশে পারেন না। এটা লজ্জার।

পৌনে ৯ বছর ধরে মোদি জমানায় কীভাবে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, তার একের পর এক উদাহরণ তুলে রাহুল বলেছিলেন, আজকের ভারতে বিরোধীদের কিছু বলতে দেওয়া হয় না। সংসদ তারা সেভাবে পরিচালনা করে। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা চীন জবরদস্তি দখল করেছে অথচ সরকারের মুখে জবাব নেই। রাষ্ট্রের কল্যাণে বিরোধীদের কোনো পরামর্শ শুনতে সরকার প্রস্তুত নয়। দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন কাছের শিল্পপতির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

রাহুল ইসরায়েলি প্রযুক্তি ‘পেগাসাস’ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেছিলেন, ‘আমার ফোনেও ওই আড়িপাতা যন্ত্র বসানো হয়েছিল। যে ভারত আজ গড়ে তোলা হয়েছে, তা দেখতে আমরা মোটেই অভ্যস্ত নই। ভারতের সমাজে বরাবরই মুক্ত আবহ ছিল। একে অন্যের কথা শুনতেন। মোদি জমানায় ভারতের সেই সমাজ পাল্টে দেওয়া হয়েছে। ভারত সম্পর্কে চিরায়ত ধারণাটাই বদলে দেওয়া হয়েছে।’

কেমব্রিজের ওই ভাষণের পর বিজেপি রাহুলকে প্রবল আক্রমণ করেছিল। বলেছিল, রাহুল বিদেশে গিয়ে দেশের বদনাম করছেন। নিন্দা করছেন। বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের ক্ষতি করছেন। পাল্টা জবাবে গত শনিবার রাহুল লন্ডনে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বারবার দেশের বদনাম করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়ে বারবার বলেছেন, গত ৭০ বছরে দেশে কিছু হয়নি। দেশকে রসাতলে পাঠানো হয়েছে, যা কিছু হয়েছে, তা করেছে তাঁর সরকার।

রাহুল বলেন, ভারতে গণতন্ত্র ইতিমধ্যেই মৃত। অথচ ইউরোপ, আমেরিকা বা যুক্তরাজ্যের মতো গণতান্ত্রিক দেশ উচ্চবাচ্য করে না অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে। ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র। অথচ ইউরোপ, আমেরিকার মতো গণতন্ত্রের তথাকথিত রক্ষাকর্তারা নির্বাক!

কংগ্রেস নেতা রাহুল আরও বলেন, ‘আমি ভারত জোড়ো যাত্রা করেছি মুক্তকণ্ঠকে উৎসাহিত করতে। সরকার সেটাই রুদ্ধ করতে চাইছে। বিবিসি তার একটা উদাহরণ। বিবিসি সরকারের বিরুদ্ধাচরণ বন্ধ করে দিক। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বিদেশে রাহুলের বক্তব্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা বিরোধীদের একাংশের চিঠির নির্যাস হুবহু এক। অথচ সেই চিঠিতে সই নেই কংগ্রেস, ডিএমকে ও বামপন্থী দলগুলোর। বিরোধী শিবিরের এই বিভক্তিই শাসক বিজেপির সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই শক্তির সবশেষ পরিণাম দেখা গেল উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডের নির্বাচনে। বিজেপি-বিরোধী শক্তিরা একজোট হতে না পারায় বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হলো এবং ক্ষমতাসীন হলো বিজেপি।

এই বিভক্তিকেই বড় করে তুলে ধরে রাহুল বলেছিলেন, বিজেপির বিরুদ্ধে সমভাবাপন্নদের নিয়ে একটাই জোট গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয় ফ্রন্টের উপস্থিতি বিজেপিরই সুবিধা করে দেবে। লন্ডনে তিনি এও বলেন, বিরোধীদের জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রে একটা চমক অপেক্ষা করছে। ঠিক সময়ে তার প্রকাশ ঘটবে। সেই চমক অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই বিজেপির হাসি চওড়া করে তৃতীয় ফ্রন্টের উপস্থিতি কিছুটা স্পষ্ট হলো আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রীকে লেখা বিরোধীদের চিঠিতে।

বিহারের আরজেডির তেজস্বী যাদব, জম্মু কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লাহ, মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ও এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ারকে বাদ দিলে বাকি পাঁচ নেতার কেউ এখনো কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের অনুগামী হয়ে বিজেপি বিরোধী অভিযানে যেতে রাজি নন। কংগ্রেস ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক না হতে অথবা তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি, ভারত রাষ্ট্র সমিতির কে চন্দ্রশেখর রাও ও সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব এখনো অনড় ও অটল। বিশেষ করে রাহুলের নেতৃত্ব মানতে তাঁদের ঘোর অনীহা।

চমকের কথা রাহুল শুনিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার কোনো আভাস এখনো নেই। সেই অবসরে নিশ্চিন্ত নিশিযাপন করে চলেছে বিজেপি।