রাম রহিমের প্যারোলে বিলাসী জীবন

গুরমিত রাম রহিম সিং গ্রেপ্তার হওয়ার আগে হানিপ্রীতের সঙ্গে।
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

হত্যা ও দুই শিষ্যকে ধর্ষণের অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ভারতের কথিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং আবারও আলোচনায় এসেছেন। এবার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়েছে। কারাগারের বাইরে এসে তিনি আগের মতোই হাজারো অনুসারী নিয়ে বৈঠক করছেন এবং আনন্দ-উল্লাস করছেন। প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার পর গত সপ্তাহে তাঁর আনন্দ-উল্লাসের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে ডেরা সচ সউদার প্রধান রাম রহিম তাঁর পালিত কন্যা হানিপ্রীতকে সঙ্গে নিয়ে কেক কাটছেন। আগে রাম রহিমের সাবেক গাড়িচালক খাট্টা সিং ও তাঁর ছেলে গুরদাস সিং অভিযোগ করেছিলেন, পালিত কন্যা বললেও রাম রহিমের সার্বক্ষণিক সহযোগী হওয়ার আগে হানিপ্রীত তাঁর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে হানিপ্রীতের সাবেক স্বামী বিশ্বাস গুপ্তও দাবি করেছিলেন, পালিত কন্যা হলেও হানিপ্রীতের সঙ্গে রাম রহিমের অবৈধ সম্পর্ক ছিল।

ইনস্টাগ্রামে গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের অনুসারীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছানো উপলক্ষে এই কেক কাটার আয়োজন করা হয়। এর কয়েক দিন আগে আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, রাম রহিম তলোয়ার দিয়ে বিশাল একটি কেক কাটছেন। এসব ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর প্রশ্ন তুলছেন সমালোচকেরা। তাঁরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ কেন রাম রহিমকে এত ঘন ঘন প্যারোলের অনুমতি দিচ্ছে?

দুই শিষ্যকে ধর্ষণের অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হন রাম রহিম। ২০১৭ সাল থেকে তিনি এই মামলায় ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের সুনারিয়া কারাগারে বন্দী। এরপর একজন সাংবাদিককে হত্যার দায়ে ২০১৯ সালে যাবজ্জীবন ও ২০০২ সালে এক কর্মচারীকে হত্যার দায়ে ২০২১ সালে আবারও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

প্যারোলে মুক্তি পেয়ে রাম রহিম তলোয়ার দিয়ে বিশাল একটি কেক কাটছেন।
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

এ ধরনের গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও রাম রহিম গত ১৩ মাসে ১৩১ দিন কারাগারের বাইরে ছিলেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২১ দিন, জুনে ৩০ দিন ও অক্টোবরে ৪০ দিনের দিনের জন্য তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত ২১ জানুয়ারি তাঁকে আবারও ৪০ দিনের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়।

হরিয়ানা রাজ্যে সিরসা শহরে রাম রহিমের প্রধান ঘাঁটি ডেরা সচ সউদা নামে পরিচিত ছিল। এই ডেরার একজন কর্মকর্তা বলেন, প্যারোল বন্দীদের অধিকার, এটি মানবাধিকার। তিনি বলেন, রাম রহিম এ সময় আধ্যাত্মিক বক্তৃতা দিচ্ছেন, মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন, আসক্তি মুক্ত করার কর্মসূচিতে কাজ করছেন।’ প্রতিদিন এক লাখ মানুষ রাম রহিমের কারণেই মাদক ছেড়ে দিচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি।

তবে রাম রহিমের এই প্যারোলে মুক্তি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাশা প্রকাশ করেছেন। শিখধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ সংগঠন শিরোমণি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটি (এসজিপিসি) রাম রহিমের প্যারোলের বিরুদ্ধে আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেছে। পিটিশনে সংগঠনটি বলেছে, এটি সমাজে ভুল বার্তা পাঠাচ্ছে।

এসজিপিসির মহাসচিব গুরচরণ সিং গ্রেওয়াল বলেন, কারাগারের বাইরের রাম রহিমের উপস্থিতি ‘সমাজের জন্য ক্ষতিকর’।

২০১৭ সালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে রাম রহিম বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁর লাখ লাখ অনুসারী ছিল। সিরসা শহরে ডেরা সচ সউদায় থাকতেন তিনি। সেখানে প্রতিবছর লাখ লাখ ভক্ত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন।

নানা রঙের বিদেশি পোশাক ও গয়নার প্রতি ভালোবাসার কারণে রাম রহিমকে ‘রকস্টার বাবা’ নামেও ডাকা হতো। তিনি নিজের নির্মাণ করা চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও রক কনসার্ট করেছিলেন। ভারতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে ছিলেন।

বিপুলসংখ্যক অনুসারী থাকায় অনেক বছর থেকেই ভারতের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কাছে গুরুত্ব পেয়েছেন রাম রহিম। অনুসারীদের ভোট ফল পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি দুই দলেরই প্রশ্রয় পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তিনি বিজেপির হয়ে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে হরিয়ানা রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তিনি অনুসারীদের বিজেপিকে ভোট দিতে অনুরোধ করেছিলেন। সে বছর এই রাজ্যে বিজেপি জয় পেয়েছিল। এরপর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টরের সঙ্গে ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে।

দোষী সাব্যস্ত হয়ে দীর্ঘ কারাবাসের পরও রাম রহিমের প্রভাব কমেনি বলে অনেকেই মনে করছেন। প্যারোলে মুক্তি নিয়ে তিনি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বাগপত জেলার বারনাওয়ার আশ্রমে আছেন। সেখান থেকে তিনি কয়েক হাজার অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠকও করছেন। এ বৈঠকে বিজেপির কয়েকজন রাজনীতিকের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এ কারণে বিরোধী দলগুলো রাম রহিমেকে বারবার প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার পেছনে বিজেপির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করছে।

তবে হরিয়ানায় বিজেপির প্রধান মুখপাত্র সঞ্জয় শর্মা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, রাম রহিমকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপি বা তাঁর সরকারের কোনো ভূমিকা নেই।

সঞ্জয় শর্মা বলেন, ‘তাঁর (রাম রহিম) প্রতি বিশ্বাস থেকেই মানুষ তাঁকে দেখতে যান বা তাঁর বক্তৃতায় অংশ নেন। তাঁর প্রতি আমাদের কোনো সহানুভূতি নেই। আমরা আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিই।’ তিনি আরও বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ বা জেলা প্রশাসন প্যারোল অনুমোদন করে। আর এটি আইনের পরিধির মধ্যে করা হচ্ছে।

হরিয়ানার রোহতাক জেলা প্রশাসনের প্রধান বিভাগীয় কমিশনার সঞ্জীব ভার্মা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, বিষয়টি বিচারাধীন ও আদালতের এখতিয়ার।

কারাগারের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আকিলও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেছেন, রাম রহিমের প্যারোলের বিরুদ্ধে একই রকম দুটি পিটিশন আদালত খারিজ করে দিয়েছেন।

গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের সঙ্গে হানিপ্রীত।
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অক্ষত বাজপেয়ী বলেন, প্যারোল পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। আর রাম রহিম কীভাবে বারবার প্যারোল পাচ্ছেন, তা বোঝা আরও কঠিন। তিনি বলেন, বন্দীদের পরিবারে মৃত্যু বা সন্তান বা ভাইবোনদের বিয়ের ক্ষেত্রে প্যারোল দেওয়া হয়। রাম রহিমের মামলা বিচারাধীন নয়, তিনি আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা পেয়েছেন। তারপরও তিন থেকে চার মাস পরপর তিনি প্যারোল পাচ্ছেন। তাঁকে একটি তলোয়ার দিয়ে কেক কাটতে দেখা গেছে, যা অস্ত্র আইনে একটি অপরাধ। তিনি মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করেছেন, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা নিয়ে উপহাস করেছেন।

১৯৪৮ সালের ২৯ এপ্রিল ডেরা সচ সউদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় হরিয়ানার সিরসা জেলায়। ভারতজুড়ে এই ডেরার প্রায় অর্ধশত আশ্রম রয়েছে। অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার কারণে ২০১৬ সালে ডেরা প্রধান রাম রহিম দাদাসাহেব ফালকে চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। বেশ কয়টি গানের অ্যালবামও বেরিয়েছে রাম রহিমের। এ ছাড়া নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। এক দিনে সর্বোচ্চ পরিমাণ রক্তদানের আয়োজন করে গিনেস ওয়াল্ড রেকর্ডসে নামও লিখিয়েছে তাঁর ডেরা।

রাম রহিমকে নিয়ে যেসব বিতর্ক

খ্যাতি আর ভক্তের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বিতর্কও পিছু ধাওয়া করতে শুরু করে রাম রহিমের। ২০০২ সাল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হত্যাসহ বেশ কয়টি অভিযোগ আসতে শুরু করে। তবে ডেরারই এক সাধ্বীর বেনামি চিঠিতেই পতনের সূচনা রাম রহিমের। রাম রহিমের এই কুকীর্তির কাহিনি ফাঁস করেছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক রামচন্দ্র ছত্রপতি। তাঁকে খবর দিতেন ডেরারই সাবেক সাধু রঞ্জিত। অভিযোগ, এই দুজনকেই স্বঘোষিত ধর্মগুরু খুন করান।

রাম রহিমের নিজের সন্তান জসমিত সিং ইনসান। ২০০৭ সালে তাঁকে ডেরার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু হানিপ্রীতের কথায় শেষে মন পরিবর্তন করেন রাম রহিম।

আরও পড়ুন

রাম রহিমের বিরুদ্ধে করা মামলায় তদন্ত সংস্থা সিবিআইয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন গুরুদাস সিং তুর। তিনি ডেরার একজন সাবেক অনুসারী। গুরুদাস সিং তুর ২০১৭ সালে বলেছিলেন, হানিপ্রীত ও রাম রহিম সন্তান চেয়েছিলেন। তবে কার ঔরসে সেই সন্তানের জন্ম, তা গোপন রাখার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। মূলত, ডেরার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী নির্বাচন করতেই হানিপ্রীত সন্তান চেয়েছিলেন।

গুরমিত সিং তুর বলেছিলেন, ‘জসমিত সিং ইনসানের বিপক্ষে ছিলেন রাম রহিম। তিনি জসমিতকে ডেরাপ্রধান বানাতে আগ্রহী ছিলেন না। ডেরার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন হানিপ্রীত। তিনি রাম রহিমের ঔরসে সন্তান ধারণ করতে চেয়েছিলেন। হানিপ্রীত ও রাম রহিম—দুজনই অনাগত সন্তানকে ডেরার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী বানাতে চেয়েছিলেন। তাঁদের পরিকল্পনা এমনই ছিল।’

গুরুদাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হানিপ্রীতের সাবেক স্বামী বিশ্বাস গুপ্তকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনাগত সন্তানের বাবা হিসেবে দেখানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের আগেই তা ভেস্তে যায়। কারণ, হানিপ্রীতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান বিশ্বাস গুপ্ত।

আরও পড়ুন

এর আগে ডেরায় থাকা কমপক্ষে দুই হাজার নারীকে রাম রহিম ধর্ষণ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন এক সাধ্বী। রাম রহিম কারাগারে যাওয়ার পর থেকে হরিয়ানায় সিরসার ডেরায় নিয়মিত অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে অভিযানের শুরুর দিকে বিপুল পরিমাণ কনডম ও জন্মনিরোধক ওষুধ জব্দ করা হয়। ডেরার ভেতর সাধ্বী হোস্টেলে রাম রহিমের সরাসরি যাতায়াত ছিল। ওই যাতায়াতের জন্যই দুটি গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়া ডেরায় পানির নিচে গোপন ‘সেক্সকেভ’ বা ‘যৌনগুহার’ সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডেরার প্রাসাদ চত্বরে যে সুইমিং পুল রয়েছে, তার নিচেই ওই ‘যৌনগুহা’ গড়ে তুলেছিলেন ডেরাপ্রধান রাম রহিম। গোপন গুহায় নারীদের নিয়ে অনৈতিক কার্যকলাপ চালাতেন তিনি।

২০১৭ সালের গত ২৫ আগস্ট দুই নারী ভক্তকে ধর্ষণের অভিযোগে করা দুটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয় রাম রহিমকে। পরে একই বছরের ২৮ আগস্ট রাম রহিমকে দুটি মামলায় ১০ বছর করে ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন সিবিআই আদালত।